মতুয়াধর্মের অপব্যাখ্যা
সুধীর রঞ্জন হালদার
আমরা লক্ষ করেছি বিভিন্ন স্হানে অনেক মতুয়া গোঁসাইরা “শ্রীশ্রীহরিলীলামৃত” গ্রন্হে বর্ণিত হরিচাঁদের বাণী, উপদেশ, তারকচন্দ্র সরকারের মন্তব্য ইত্যাদির বিকৃত ব্যাখ্যা করে মতুয়াধর্মকে বৈদিক হিন্দুধর্মের সঙ্গে একাত্ম করে দিয়ে বৈদিক আচার পালনের জন্য ভক্তমহলে প্রচার করে থাকেন। তাঁরা মতুয়াধর্ম যে একটি আলাদা অবৈদিক ধর্ম তা প্রচার করেন না এবং স্বীকারও করেন না। সেইসব গোঁসাইরা দু’রকমের হয়ে থাকেন। একদল না বুঝে পূর্ববর্তী অজ্ঞ গোঁসাইদের উপদেশ অনুসরণ করে নিজেরাও ভুল পথে পরিচালিত হয়ে ভুল ব্যাখ্যা করেন। যাঁরা মতুয়াধর্মের প্রকৃত মর্ম না বুঝে এসব করে থাকেন, তাঁদের সম্পর্কে এইটুকুই বলা যায় যে, তাঁরা যেন জ্ঞানালোকপ্রাপ্ত মতুয়াদের কাছ থেকে সঠিক তথ্য ও তত্ত্ব জানার চেষ্টা করেন এবং মতুয়াধর্ম যে বৈদিক হিন্দুধর্ম থেকে একটি আলাদা অবৈদিক ধর্ম তা বুঝে সে সম্পর্কে সঠিক উপদেশ ভক্তমহলে প্রচার করেন। দ্বিতীয় যে সব গোঁসাইরা বিকৃত ব্যাখ্যা করেন, তাঁরা কিন্তু জেনেবুঝেই এসব করে থাকেন। তাঁরা চতুরালি করে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যই এসব করে থাকেন। তাঁরা আসলে ছদ্মবেশধারী ব্রাহ্মণ্যবাদী মতুয়া অর্থাৎ ভণ্ড মতুয়া। তাঁরা গোঁসাই বেশে ব্রাহ্মণ্যবাদী কায়দায় গুরুগিরি করে নিজেদের প্রভাব প্রতিপত্তি বাড়াবার জন্য এবং বিনাশ্রমে দুধ-সর-ননি-মাখন খেয়ে শরীর পালন ও আর্থিক শ্রীবৃদ্ধিকল্পে মতুয়াদের ব্রাহ্মণ্যবাদী করে তোলার জন্য সব সময়ই সচেষ্ট। বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ভারতের অন্যান্য প্রদেশে এমন ধূর্ত মতুয়া-গুরুদের আবির্ভাব ইদানিং বেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। তাঁরা হরিচাঁদ ঠাকুরকে পুরোপুরি হিন্দুদের কল্পিত সৃষ্টিকর্তা বিষ্ণুর অবতার রাম, কৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ প্রমুখের উত্তরসূরি রূপে ব্যাখ্যা করেন এবং মতুয়াধর্ম কোনো আলাদা ধর্ম নয়, হিন্দুধর্মেরই অঙ্গীভূত বলে প্রচার করে থাকেন। এঁরা রাম, কৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ ইত্যাদির জয়ধ্বনি দিয়ে, হরিচাঁদ ঠাকুরের পাশে তাদের ছবি রেখে ভক্তদের দিয়ে মহোৎসব করান, রাম, কৃষ্ণ, গৌরাঙ্গ ইত্যাদির লীলা বর্ণনা করে কীর্তন করান, এবং গুরুপূজা, গুরুপ্রণামী ও গুরুদক্ষিণা নিয়ে দীক্ষা দিয়ে মতুয়াভক্তকে শিষ্য করেন। মহোৎসবের নামে হাজার হাজার টাকা, এমনকি লক্ষাধিক টাকাও এভাবে তাঁরা লুট করে নিয়ে যান। এটাই তাঁদের একমাত্র জীবিকা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ছদ্মবেশী এইসব মতুয়া-গুরুদের মধ্যে অনেকে বৈদিকধর্মের তথাকথিত উচ্চবর্ণের লোকও আছেন। তাঁদের মদত দেন স্থানীয় শিক্ষিত ধূর্ত মতুয়াবেশধারী সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তিরা।
মতুয়া মহলে দীক্ষা দেবার দোহাই হিসাবে এইসব গুরুরা হরিচাঁদের বাণীর অপব্যাখ্যা করে বলেন-
“অদীক্ষিত, করিবে না তীর্থ পর্যটন।
মুক্তি স্পৃহা শূন্য, নাই সাধন ভজন।।’’
এর ব্যাখ্যা করেন- “দীক্ষা না নিয়ে কেউ তীর্থ-পর্যটনে যাবে না। যার মুক্তি স্পৃহা নেই, তার সাধন ভজনও হয় না। সুতরাং দীক্ষা নাও, তারপর তীর্থ করতে যাও। অন্তরে মুক্তির বাসনা নিয়ে সাধন-ভজনে এগিয়ে যাও। অনেক বিজ্ঞ পাঠক নিশ্চয়ই এ ব্যাখ্যা শুনে হাসবেন। কিন্তু সত্যি বলছি, এই প্রতিবেদক সাধারণ সহজ সরল ভক্ত মহলে ওইসব গুরুদের এই ব্যাখ্যা স্বকর্ণে শুনেছেন এবং ভক্তদের মধ্যে মতুয়ামতে দীক্ষা নেওয়ার প্রথাও বহুল প্রচারিত প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ভারতের অন্যান্য প্রদেশের স্থানীয় লোক তথা সহজ সরল আদিবাসীদেরও এইভাবে দীক্ষা দিয়ে চলেছেন।
উপরে উদ্ধৃত লীলামৃতের বাণীটির এমন ব্যাখ্যা বাংলাদেশ তথা পশ্চিমবঙ্গের অনেক গুরু-গোঁসাইরাও করে থাকেন। কিন্তু তাঁরা এটা লক্ষ করেন না যে, ওই গ্রন্হেই অন্যত্র বলা হয়েছে- “বিশুদ্ধ চরিত্র প্রেমে হরি হরি বলে।
অন্য তন্ত্র-মন্ত্র এরা বাম পদে ঠেলে। ”(পৃঃ ৭০)
আবার হরিচাঁদ ঠাকুরের প্রতিভূ হিসাবে যিনি আজন্ম মতুয়াধর্ম প্রচার করে গিয়েছেন, সেই গুরুচাঁদ ঠাকুর বলেছেন-
“দীক্ষা বৃথা, কর বৃথা তীর্থ পর্যটন।
মুক্তি বৃথা, কিবা কর সাধন ভজন\” (শ্রীশ্রীগুরুচাঁদ চরিত, পৃঃ ১৪)
আবার-
“এক জাতি এক প্রাণ, সবে ডাকে হরিচান,
একই তরঙ্গে ভাসে একই সাগরে।
নাহি দেবদেবী পূজা, দীক্ষাহীন মহাতেজা,
একই মহামন্ত্রে বলে সবে জাগোরে।।”(ঐ, পৃঃ ৭০)
এ সম্পর্কে আরও উদাহরণ আছে। যথা-
“মন্ত্রতন্ত্র দীক্ষা নাই, পবিত্রতা রক্ষা চাই,
গৃহধর্মে সব পাই মানব জীবনে।
পবিত্রতা সত্য বাক্য, মনে যেবা করে ঐক্য,
হরি আছে তার পক্ষ সদা সর্বক্ষণে।।” (ঐ, পৃঃ ৪৮৪)
কিংবা
“দীক্ষা শিক্ষা কোন কিছু নাহি প্রয়োজন।
হরিনাম মহামন্ত্র জান সর্বজন।।” (ঐ, পৃঃ ৫৭৩)।
আবার মুক্তি প্রসঙ্গে লীলামৃতে আছে-
“মুক্তি শ্রেষ্ঠ ব্যাখ্যে যারা ভক্তি নাহি চিনে।
হরি নামে পাপ ক্ষয় তারা ইহা ভণে।
মুক্তিকে যে তুচ্ছ করে ভক্তি করে সার।
পুণ্যকে না দেয় স্হান পাপ কোন ছার।।” (পৃঃ ৪)
অর্থাৎ মতুয়ারা মুক্তিকে তুচ্ছ করে ভক্তিকে সার মনে করেন। তাই তাঁরা সাধন-ভজন করারও কোনো প্রয়োজন মনে করেন না।
আশা করি সাধারণ মতুয়াধর্মী লোকেরা এত সব উদাহরণ উপস্হাপিত করার পরে আর এই সব অজ্ঞ এবং ভণ্ড মতুয়া গুরু-গোঁসাইদের অপব্যাখ্যায় বিভ্রান্ত না হয়ে সঠিক তত্ত্ব উপলব্ধি করতে পারবেন এবং মতুয়াধর্মের পবিত্রতাকে রক্ষা করে চলবেন।
0 comments:
Post a Comment