আমাদের বিদ্যাসাগর–
গুরুচাঁদ ঠাকুর
– সুধীর রঞ্জন
হালদার
বাঙালিদের
মধ্যে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা কে না জানেন? বিদ্যাসাগর
যদিও একটি সংস্কৃত শিক্ষার উপাধি এবং একাধিক ব্যক্তিই এই উপাধি লাভ
করেছেন, তথাপি বিদ্যাসাগর বললেই সবাই ঈশ্বরচন্দ্রকেই
বোঝেন। শুধু যে
বিদ্যার সাগর তাইই নয়, দয়ার সাগর, করুণার সাগর
ইত্যাদি বিশেষণেও তাঁকে বিভূষিত করা হয়। তাঁর দয়া, করুণা, মাতৃভক্তি সম্বন্ধে যে কত গল্প তৈরি হয়েছে তারও
ইয়ত্তা নেই। বিভিন্ন
স্কুল-কলেজের দেয়ালে তাঁর নামে প্রশস্তিমূলক ছড়া-কবিতাও হামেশা দেখতে পাই। এদেশে
সর্বজনীন শিক্ষাবিস্তারের কথা বলতেও একবাক্যে সবাই
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কথা বলেন। বই-পুস্তকে তাঁর সমাজ সংস্কারের অসামান্য অবদানের
কথা পড়ি, প্রাতঃস্মরণীয় মনীষী হিসাবে তাঁকে শ্রদ্ধার
সঙ্গে স্মরণ করি।
কিন্তু
ভারতবর্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র,
অবহেলিত, পতিত,
অস্পৃশ্য জনগণ– যাঁরা এই দেশের বৃহত্তম
সংখ্যক মূলনিবাসী, তাঁদের জন্য তিনি কী করেছেন, এ প্রশ্ন কি আমরা– এই অবহেলিত মূলনিবাসীরা কোনোদিন করেছি? এই দয়ার সাগর, করুণার সাগর
বিদ্যাসাগর তাঁদের শিক্ষার জন্য কী করেছেন তার অনুসন্ধান কি আমরা
কখনও করেছি? যদি সেই অনুসন্ধান করি তা হলেই জানতে পারব
যে, তথাকথিত অস্পৃশ্য মূলনিবাসী মানুষদের জন্য
তিনি কিছুই করেননি তো বটেই,
উপরন্তু তাঁরা যাতে শিক্ষার ধারে কাছেও ঘেঁষতে না পারেন, তার ব্যবস্হাই তিনি করে গিয়েছেন। ইতিহাসের পাতা থেকে দু-একটি উদাহরণ দিলেই এর
সত্যতা জানা যাবে।
১৮৫৯ সালে
তৎকালীন বৃটিশ সরকার যে শিক্ষানীতি
ঘোষণা করে তার উদ্দেশ্য ছিল মাতৃভাষার মাধ্যমে নিচু জাতের মধ্যে শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়া। এই সময়ে বাংলার লেফটেন্যান্ট গভর্ণর ছিলেন
স্যার জন পিটার গ্রান্ট।
ওই বছরের ২৯ সেপ্টেম্বর
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর শিক্ষানীতি সম্পর্কে তাঁর মতামত জানিয়ে পিটার গ্রান্টকে যে চিঠি লেখেন তার অংশ
বিশেষের বাংলা অনুবাদ এখানে তুলে দিচ্ছি–
‘‘এদেশে এবং
ইংল্যাণ্ডে এমন একটা অলীক ধারণার সৃষ্টি করা হয়েছে যেন উচ্চবর্ণীয়দের শিক্ষার ব্যপক সাফল্য অর্জন করা গেছে, এখন নিম্নবর্ণের লোকেদের শিক্ষার প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। কিন্তু বিষয়টা যদি অনুসন্ধান করা হয় তবে
সম্পূর্ণ ভিন্ন চিত্র দেখা দেবে। তাই আমার বিনীত অনুরোধ, শিক্ষা
বিস্তারের একমাত্র উৎকৃষ্ট পন্হা হিসাবে সরকার সমাজের উচ্চবর্ণের মধ্যে শিক্ষা সীমিত রাখুন। উঁচু জাতের মধ্যে ব্যাপক শিক্ষার বিস্তার ঘটালেই শিক্ষা নীতি সফল হবে।” (Education Department proceedings, October 1960 (No.53)25 quoted by
R.K.Biswas in article ‘A Nation of slow Learners’ in the Telegraph,
Calcutta, December 23, 1993.)
আগে ‘‘কায়স্হ জাতির কলকাতার সংস্কৃত কলেজে পড়বার
অধিকার ছিল না– কারণ তারা শূদ্র। অব্রাহ্মণদের সংস্কৃত কলেজে পঠন পাঠনের
অধিকারের প্রশ্ন ওঠে ১৮৫১ সালে। এডুকেশন কাউন্সিলের সচিব এ সম্পর্কে উক্ত কলেজের
অধ্যক্ষ ঈশ্বরচন্দ্রের মতামত চেয়ে পাঠান। ১৮৫১ সালের ১৮ই মার্চ এডুকেশন কাউন্সিলের
সচিব Captain F.F.C. Hayes কে তিনি এক দীর্ঘ পত্র লিখেছিলেন। সেই পত্রের বক্তব্য সংক্ষিপ্ত আকারে তুলে দিচ্ছি–
‘‘শাস্ত্রমতে শূদ্রের কর্তব্য হল ব্রাহ্মণ, ক্ষত্রিয় এবং বৈশ্য– এই তিন উৎকৃষ্ট বর্ণের সেবা করা। মনুর কালের বিধান। কায়স্হরা শূদ্র। তবু এ
নিয়ম তাদের ক্ষেত্রে পুরোপুরি কঠোর ভাবে প্রযোজ্য নয়। গোঁড়া ব্রাহ্মণগণ আজকাল তাদের শাস্ত্রশিক্ষা ও দীক্ষা
দিচ্ছে। সংস্কৃত
সাহিত্য পাঠ শূদ্রদের নিষিদ্ধ নয়;
তারা কেবল পবিত্র ধর্মগ্রন্হ
পড়তে পারবে না। বর্তমানের
প্রচলিত নিয়মানুসারে বৈদ্যজাতি সংস্কৃত কলেজে পড়ার অধিকারী। রঘুনন্দন স্মৃতি মতে বৈদ্যরাও শূদ্র; কায়স্হদের তুল্য। বৈদ্য জাতির মতো কায়স্হদেরও সংস্কৃত কলেজে
পড়তে দিতে আমার আপত্তি নেই। তবে কায়স্হ ছাড়া অন্য নিম্নবর্ণের লোকেদের এই কলেজে
ভর্তিতে আমার আপত্তি আছে। কারণ জাতের সিঁড়িতে তারা অনেক নীচেয় এবং সম্ভ্রান্ত
নয়।
তাদের ভর্তি করলে এই
মহাবিদ্যালয়ের মান ও মর্যাদাক্ষুণ্ন
হবে বলেই আমি আশঙ্কা করি। পরিশেষে জানানো দরকার যে কায়স্হদের এই কলেজে ভর্তির
প্রস্তাবে এখানকার পণ্ডিতরা ঘোর খাপ্পা; এটা তাদের
আদৌ মনঃপুত নয়।” (বিনয় ঘোষঃ
বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ;
ওরিয়েন্ট লং ম্যান, কলকাতা ১৯৭৩, পৃষ্ঠা
৫৪২-৫৪৪, শিপ্রা বিশ্বাস কর্তৃক উদ্ধৃত, অণ্বেষণ ২য় পর্ব , অদল বদল, আগষ্ট, ১৯৯৪)
এর চার বছর
পরে যখন সুবর্ণ বণিকদের সংস্কৃত কলেজে পড়ার প্রশ্ন ওঠে তখন শিক্ষা অধিকর্তা গর্ডন ইয়ং-কে বিদ্যাসাগর যে চিঠিটি পাঠান
তার সারসংক্ষেপ হল–
‘‘১৮৫১ সাল পর্যন্ত ব্রাহ্মণ এবং বৈদ্য জাতিকে এই কলেজে ভর্তি করা হত। তারপর শূদ্র জাতের মধ্যে সবচেয়ে সম্ভ্রান্ত
জাতি কায়স্হদের এখানে পড়বার সুযোগ দেওয়া হয়। পরে ১৮৫৪ সালে কলেজের দ্বার সম্ভ্রান্ত
সমস্ত জাতির জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়। কিন্তু আমি দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি যে, আবেদনকারী সুবর্ণবণিকদের সংস্কৃত কলেজে ভর্তি করা
যাবে না। এটা
সত্যি কথা এই জাতির অনেকে কলকাতায় খ্যাতিমান এবং জনপ্রিয়। তা হলে কী হবে–জাতের সিঁড়িতে তারা অতি
নীচুতে। ছোটজাতের
লোকদের সংস্কৃত কলেজে প্রবেশাধিকার এখানকার পণ্ডিতদের মর্মপীড়া এবং অখ্যাতির কারণ
হবে।
কলেজের জনপ্রিয়তা ভীষণ ভাবে
হ্রাস পাবে। যত
উদারতা ও সহানুভূতি সম্ভব,
পূর্বেই দেখিয়েছি; এর পরে আর নয়। কলেজের দ্বার আবেদন প্রার্থীদের জন্যে খুলে দিতে আমি
রাজী নই। পারলে
আমি খুশী হতাম।” (বিনয় ঘোষঃ বিদ্যাসাগর ও বাঙালী সমাজ; শিপ্রা বিশ্বাস কর্তৃক উদ্ধৃত, অণ্বেষণ ২য় পর্ব, অদল বদল, আগষ্ট, ১৯৯৪)
সুতরাং এ
কথা নিঃসংশয়ে বলা যায় যে,
ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর
অস্পৃশ্য মূলনিবাসীদের শিক্ষার
জন্য কিছুই করেননি তো বটেই উপরন্তু সরকারের সেই প্রচেষ্টাকেও তিনি বানচাল করে
দিয়েছেন। তিনি শিক্ষার দ্বার সকলের জন্য খুলে দিয়ে গেছেন বলে যা প্রচার
করা হয় তা সর্বৈব মিথ্যা। তিনি যা কিছু করেছেন- তা যে মুষ্টিমেয় কিছু
উচ্চবর্ণীয়দের জন্য করেছেন,
এ কথা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
পক্ষান্তরে ‘মতুয়া’ ধর্মের স্রষ্টা হরিচাঁদ ঠাকুরের নির্দেশে তাঁর পুত্র
গুরুচাঁদ ঠাকুর এইসব সংখ্যাগরিষ্ঠ মূলনিবাসী মানুষদের জন্য মনুর বিধানকে অগ্রাহ্য
করে কৃষি, ব্যাবসা এবং শিক্ষার ব্যবস্হা করতে জীবনপাত করেছেন। গুরুচাঁদের নির্দেশ ছিল গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন কমিটি বানিয়ে প্রতিদিন প্রতি
পরিবারে এক মুঠো করে চাল সঞ্চয় করে শিক্ষার
আন্দোলনে কাজে লাগাতে হবে। গ্রামে বিবাহ, শ্রাদ্ধ ও
অন্যান্য অনুষ্ঠানে যা খরচ হবে তার তিন শতাংশ এই তহবিলে চাঁদা দেওয়ার নিয়ম চালু
করা হয়। ২০ বছরের
কম কোনও নমঃশূদ্র পাত্র এবং ১০ বছরের কম কোনও পাত্রীকে বিবাহ দেওয়া নিষিদ্ধ করা
হয়।
ঈশ্বরচন্দ্র
উচ্চবর্ণীয়দের শিক্ষা বিস্তারের জন্যই বা ক’টা স্কুল তৈরি করেছিলেন? মোট ৩৬টি বিদ্যালয় স্হাপন করার খবর জানা যায়। অথচ উচ্চশিক্ষায় বঞ্চিত গুরুচাঁদ এই অবহেলিত সমাজের মানুষের জন্য
সারা বাংলায় শিক্ষা-আন্দোলনের মাধ্যমে আঠারোশো-এরও বেশি স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর যার ধারে কাছেও যেতে
পারেননি। গুরুচাঁদ
ঠাকুরই নমঃশূদ্রদের মধ্যে শিক্ষার
একটা জোয়ার এনেছিলেন। তাঁর
জন্য আমরা পেয়েছি আমাদের সমাজে যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডলকে, মুকুন্দ মল্লিককে– এবং আরও আরও বহু মনীষীদের। বর্তমানে আমাদের সমাজে যে লক্ষ লক্ষ
মানুষ শিক্ষার আলোয় আলোকিত হয়েছেন, চাকরি, ব্যবসায়, শিল্প ইত্যাদি গড়ে সমাজে যে একটি বিশিষ্ট স্হান দখল
করেছেন, তার আলোক বর্তিকা জ্বালিয়েছিলেন এই মহান
পুরুষ গুরুচাঁদ ঠাকুর– বিদ্যাসাগরীয় ধারায় যা কোনও দিন সম্ভবপর হত না। তাহলে আমাদের কাছে কে প্রাতঃস্মরণীয়
মহাপুরুষ, কে আমাদের কাছে বিদ্যাসাগর? নিশ্চয়ই ঈশ্বরচন্দ্র বন্দোপাধ্যায় নয়। কাকে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করব? নিশ্চয়ই বর্ণবিদ্বেষী পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র
বিদ্যাসাগরকে নয়– আমাদের এই অল্প লেখাপড়া জানা, দয়ার সাগর– মহান পুরুষ গুরুচাঁদ
ঠাকুরই আমাদের বিদ্যাসাগর। সকলের আগে আমাদের তাঁকেই
শ্রদ্ধা জানানো উচিত নয় কি?
0 comments:
Post a Comment