বিচারের বাণী Bicharer Bani

  • বিচারের বাণী
    সুধীর রঞ্জন হালদার
    ঝাটিমাটির ঘরখড়ের চালাতারই দাওয়ায় চুপচাপ বসেছিল মোতিয়াদিন ধরে শরীরটা ভাল যাচ্ছে না একমাত্র ছেলে রামুরযা গরম পড়েছে এই কদিন! বেলা এক প্রহর হলেই আর বাইরে বেরোয় কার সাধ্য! আকাশ থেকে যেন ঝরে পড়ে আগুনের গোলাবাইরের বাতাস গায়ে লাগলে পুড়ে ওঠে চামড়াবাইরে বেরোতে হলে পাগড়ি বাঁধতে হয় মাথায়কান ঢেকে সাবধানে চলাচল করতে হয়তারই মধ্যে কদিন সকাল সন্ধ্যা কাজ করতে হয়েছে রামুকেঠিকাদারের কাছে ট্রাক্টর চালানোর কাজনদীর মধ্যে ট্রাক্টর নামিয়ে বালি পাথর ভর্তি হলে নিয়ে যেতে হয় কাজের জায়গায়রোদের মধ্যে চলাচল করা ছাড়া উপায় থাকে না এ কাজেসম্ভবত গরমেই ধরেছে ওকেশরীরে যেমন বল নেই, তেমন খেতেও পারছে না কিছুরাত্রে রাত্রে জ্বরও হচ্ছে কদিনতাই কাজে যায়নি গত দুদিন।  আজকেও কাজে যেতে দেয়নি রামুকেঘরের ভেতরে শুয়ে আছে বিছানায়
    বছর ষোলো মাত্র বয়স হয়েছে রামুরএই বয়সেই যথেষ্ট পরিশ্রম করে ওনা করেই বা উপায় কী? ছোটো বোন আর মাকে নিয়ে তিনজনের সংসার তো ওকেই টানতে হয়ওর বাবা ধনঞ্জয় বিশই বছর চারেক আগে মারা গিয়েছে লিভারের অসুখেলিভার বলে নাকি আর কিছু অবশিষ্ট ছিল না মরার আগেতারপর অনেক কষ্টেসৃষ্টে কয়েকটা বাবুদের কোয়ার্টারে ঝি-এর কাজ করে চালিয়েছে মোতিয়াকিন্তু মোতিয়ার শরীরেও বাসা বেঁধেছে রোগসময়ে অসময়ে জ্বর, খুস্‌খুসে কাশিশরীর দিন দিন দুর্বল হয়েছে আরওঝি-এর কাজ ছাড়তে হয়েছে বাধ্য হয়েইযেমন নিজের অক্ষমতা, তেমন বাবুরাও অজানা রোগের আশঙ্কায় কাজে রাখেনি আরঅগত্যা রামুকেই হাল ধরতে হয়েছে তিনটে প্রাণীর জীবন ধারণের ব্যবস্হা করতে
       ধনঞ্জয়-মোতিয়াদের মতো পরিবারের ছেলেমেয়েদের অতি শৈশবেই হাতেখড়ি হয় কায়িক পরিশ্রমের কাজেঅপুষ্টিতে ভোগা শরীর নিয়ে শিশুশ্রমিক হয়েই জীবন শুরু হয় ওদেরমাঠেঘাটে, হাটেবাজারে কিংবা ঠিকাদারের কাছে ভর্তি হয়ে যায় সামর্থ্য অনুযায়ী যে যার কাজেকাজ করতে করতেই একদিন বড় হয় ওরাআসে যৌবনপাতে নতুন সংসারমেতে ওঠে সৃষ্টিসুখের উল্লাসেঅতিরিক্ত পরিশ্রমের কষ্ট ভুলতে মহুয়া মদের নেশায় মাতাল হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে ওরাতারপরে আসে জীবনে ভাটির টানআসে বার্ধক্যশরীরে বাসা বাঁধে নানান জটিল রোগকিন্তু কাজ পিছু ছাড়ে না ওদেরকাজ করতে করতেই একদিন আশ্রয় নেয় চিরনিদ্রার কোলেপরিসমাপ্তি ঘটে ওদের জীবনপরিক্রমার
    কিন্তু রামুকে তেমনটি হতে দিতে ইচ্ছে ছিল না মোতিয়া আর ধনঞ্জয়েরতখন এত অভাবও ছিল না সংসারেথাকতও না রাস্তার ধারে এই ঝাটিমাটির ঘরেতখন থাকত একটা সরকারি কোয়ার্টারেইদন্ডকারণ্যের কনস্ট্রাকসন বিভাগে ঠিকা শ্রমিক হিসেবে কাজ করত ধনঞ্জয়সরকারি কাঠের গুদামে রাত্রের পাহারার কাজ ছিল ওরযদিও স্হায়ী চাকরি ছিল না, তবুও সপ্তাহান্তে দৈনিক হিসেবে সরকারি রেটে যা পেত, তাতে স্বচ্ছন্দে চলে যেত ওদেরআশা ছিল বছর দুয়েকের মধ্যেই চাকরিও পাকা হবেআশেপাশে ছিল আরও অনেক কোয়ার্টারছিল রিহ্যাবিলিট্যাশন রিক্ল্যামেশন অরগনাইজেশনের বড় গ্যারেজ- ওয়ার্কসপকত কর্মচারী ছিলছিল তাদের ছেলেমেয়েদের জন্য সরকারি ইস্কুলকত রমরমা ছিল এখানকারজঙ্গলের মধ্যে গড়ে ওঠা এই জায়গাটা তখন ছিল একটা ছোটোখাটো শহরের মতোই
    সেই ইস্কুলে রামুকে ভর্তিও করে দিয়েছিল ধনঞ্জয়যদি লেখাপড়া শিখে একটা পাশ দিতে পারে, তাহলে কোয়াটারে থাকা ওইসব বাবুদের মতো একদিন চাকরিও করতে পারবে রামুতখন আর রামু বলেও ডাকবে না কেউরামবাবু বলেই ডাকবে সবাইধনঞ্জয়-মোতিয়াও হবে তখন রামবাবুর বাবা-মা
    সরকারি গ্যারেজে কাজ করত কৃষ্ণাইয়াড্রাইভার কাম মেকানিকএকা থাকত ধনঞ্জয়-মোতিয়াদের পাশের কোয়ার্টারেবউ-ছেলেমেয়ে থাকত অন্ধ্রের কোন অজ-পাড়াগাঁয়েএকা একা থাকতে বড় মন খারাপ লাগত তারধনঞ্জয়ের সাথে বড় ভাবও ছিলঅবসর সময়ে একসঙ্গে বসে গল্পগুজব করতকোনো কোনো সন্ধ্যায় দেশীয় পানীয়ের সদ্ব্যবহারও চলত দুজনেরকৃষ্ণাইয়া বড় ভালোবাসত ছোট্ট রামুকেওকে দেখলে মনে পড়ত ওর নিজের ছেলের কথারামুকে কোলে তুলে নিয়ে আদর করতকখনও গাড়ি নিয়ে ট্রায়ালে বেরোলে রামুকে তুলে নিত সাথেকোলে বসিয়ে গাড়ি চালাতজিপ, লরি, ট্রাক্টর- সব ধরণের গাড়ি
    সব কিছু স্বচ্ছন্দ গতিতেই চলছিল ধনঞ্জয়-মোতিয়ার সংসারেপাঁচ বছর বয়স হতেই নিয়মিত ইস্কুলেও পাঠিয়েছে রামুকেখুব একটা মেধাবী না হলেও এক এক করে পাঁচ ক্লাস পর্যন্ত পড়াশুনাও চলছিল স্বাভাবিক ভাবেই
    কিন্তু ছোট্ট রামুর একটা নেশা হয়ে গিয়েছিল গাড়িতে চড়ে ঘোরা আর গাড়ি চালানো শেখা।  ইস্কুল ছুটির শেষে কৃষ্ণাইয়া আঙ্ক্‌ল-এর সাথে এক চক্কর গাড়িতে না ঘুরলে মন খারাপ হত রামুর।  কৃষ্ণাইয়াও সুযোগ পেলেই সানন্দে ওকে নিয়ে এক চক্কর ঘুরে আসত আশেপাশেতখন রামুর মনে হত পৃথিবীতে কৃষ্ণাইয়া আঙ্ক্‌ল-এর মতো মানুষ আর দ্বিতীয়টি নেইআর এই ড্রাইভারের কাজের মতো কাজও আর কিছু হয় নাকত জায়গা ইচ্ছে মতো হুস্‌ করে ঘুরে আসা যায়বড় হয়ে ও যে একজন ড্রাইভার হবে সে বিষয়ে সেই শিশু বয়সেই স্হিরনিশ্চিত করে নিয়েছিল রামুকৃষ্ণাইয়ার পাশে বসে এটা কী- সেটা কী, এটায় কী হয়- সেটায় কী হয় ইত্যাদি প্রশ্নবাণে জর্জরিত করে তুলত তাকে।  আর কৃষ্ণাইয়াও শিশু রামুর প্রশ্নের উত্তর দিতে অতিরিক্ত উৎসাহ দেখাত সবকিছু হাতেকলমে দেখিয়ে দিয়েঅবশেষে একদিন দশ বছরের রামু কৃষ্ণাইয়ার পাশে বসে সত্যি সত্যি জীপ চালিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিল
    এ পর্যন্ত সবই ঠিক ছিলহঠাৎই শুরু হল অনেক অদল বদলরিক্ল্যামেশনের কাজ শেষ হয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে গেল এখানকার সরকারি গ্যারেজটিসমস্ত কর্মচারীরা বদলি হয়ে চলে গেল কে কোন মুলুকেচলে গেল রামুর কৃষ্ণাইয়া আঙ্ক্‌লসরকারি কোয়ার্টারগুলির অধিকাংশই বিক্রি করে দেওয়া হল ঠিকাদারের কাছেসেগুলি ভেঙে নিয়ে গেল ভাঙাচোরার দরে বিক্রি করবে বলেভেঙে নিয়ে গেল ধনঞ্জয়-মোতিয়াদের থাকার কোয়ার্টারটিওফাঁকা পড়েছিল বলেই তো অবৈধভাবে ওটিতে থাকত ওরাবাধ্য হয়েই তখন ওদের তুলতে হয়েছে ঝাটিমাটির ঘরতাতেও কোনো অসুবিধা ছিল নাকিন্তু হঠাৎই মারা গেল ধনঞ্জয়সরকারি হাসপাতালে ভর্তি করেও বাঁচানো গেল না আরএখন সকলের পেটের ভাত জোগাড় করাই দায় হল মোতিয়ারপড়াশুনাও মাথায় উঠল রামুরভর্তি হয়ে গেল রাস্তার ধারে এক চায়ের দোকানে ধোয়ামোছা আর টিউবওয়েল থেকে টিনের কাউরি করে জল আনার কাজে
    কিন্তু যার মাথায় চেপেছে ড্রাইভার হওয়া আর গাড়িতে চড়ে ঘুরে বেড়ানোর সাধ, সে কি আর চায়ের দোকানের এই তুচ্ছ কাজে স্হির হয়ে মন বসাতে পারে?
    রাস্তার ধারে চা খেতে আসে কত রকমের লোককরিৎকর্মা রামু কদিনের মধ্যেই আলাপ জমিয়ে ফেলল এক ঠিকাদারের ট্রাক্টর ড্রাইভারের সাথেড্রাইভার হওয়ার বড় সাধ রামুর, সে কথাও জানায় তাকেআপাতত ঠিকাদারের কাজে ভর্তি হতে পারলেই হবেআর যদি শিখিয়ে পড়িয়ে নেয়, তাহলে অনায়াসে এই ট্রাক্টরই চালাতে পারবে রামু।       
    রাধানাথ পট্টনায়ক বড় ঠিকাদারঅফিস কাছারি. থানা পুলিস সর্বত্রই তার অবাধ গতিখাতিরও সর্বত্ররাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, ইস্কুলবাড়ি- কতকিছুর কাজ এখানে থাকে প্রায় বারোমাসই।  নদী থেকে তুলে আনতে হয় নানা কাজের জন্য বালি আর পাথরবড় বড় লরির পক্ষে বালিপাথর নিয়ে নদী থেকে উঠে আসতে অসুবিধা হয়এ কাজের উপযুক্ত বাহন হল ট্রাক্টরপেছনে একটি ট্রলি জুড়ে মাল ভর্তি করে অনায়াসে প্রায় খাড়াভাবেই উঠে আসতে পারে ট্রাক্টরএ জন্য রাধানাথ নীলামে কিনে নিয়েছে দু-দুটো সরকারি ট্রাক্টরতার একজন ড্রাইভার অবিনাশ বক্‌শিতাকেই কাজের জন্য ধরে পড়ল রামু
    অবিনাশ বক্‌শিই একদিন রাধানাথ ঠিকাদারের কাজে ঢোকাল রামুকেকিন্তু বড্ড খাটুনির কাজ।  ওইটুকু ছেলে- সারাদিন বালিপাথর বয়ে তুলতে হয় ট্রলিতেবড় কষ্টের কাজতবু তার জন্য পিছপা হয় না রামুনদী থেকে ট্রাক্টর তুলে রাস্তায় নিয়ে এসে রামুর হাতে স্টিয়ারিং ছেড়ে দেবে অবিনাশ।  বাকি পথটুকু চালিয়ে নিয়ে আসবে রামুসেই আশায় সমস্ত কষ্ট সহ্য করে যায়আর সত্যি সত্যি এমনি করে গাড়ি চালানো পুরোপুরি শিখেও নেয় একদিন
    এখন রামু ড্রাইভার হয়েছেউপযুক্ত বয়স হয়নি বলে লাইসেন্স পায়নিকিন্তু এই জঙ্গলের দেশে কে দেখতে আসছে ওইসবআর যখন ঠিকাদার রাধানাথ পট্টনায়কের কাজ করে রামুপুলিশ তো তার হাতের মুঠোয়বয়স কম বলে ওর মাইনেও অর্ধেকঅথচ কাজ করে একজন পুরো ড্রাইভারের
    এই কাজ করতে গিয়েই শরীর খারাপ হয়েছে রামুরতাই কাজেও যায়নি আজ নিয়ে এই তিনদিন হল
    কিন্তু শরীর খারাপ বলে দুদিন বিশ্রাম নেবে সে উপায় নেই রামুররামু একদিন কাজে না গেলে ঠিকাদারের ক্ষতি হবে যে! ঠিকাদারের ক্ষতি করে শুয়ে বসে আরাম করবে ঘরে, তা-ও কী হয়! একদিন না যাওয়ায় গতকালই লোক পাঠিয়েছিল ঠিকাদার ওকে ডেকে নিয়ে যেতে। 
    যে ছেলেটিকে পাঠিয়েছিল তাকে চেনে মোতিয়াতার নাম ঘাসিরামআগে রামুর সঙ্গে এসেছেও বাড়িতেঘাসিরামকে দেখে জিজ্ঞেস করেছিল মোতিয়া- কণ পাই আসিলু ঘাসিয়া? তু আজি কামরে যাউ নাই?
    ঘাসিরাম বলল- যাইছি যে, মাত্র রামুকু ডাকিবা পাই আসিলিরামু কোয়াড়ে?
    মোতিয়া বলল- তার দেহ খরাপজ্বর হেইছিশুই পড়িছি ঘরেকামরে যাই পারিব নাই
    -ন গলে বাবু রাগি যিবযাউনি বোলি বহুত গালি দেই সারিলেবালিপত্থর ন আনিলে কাম বন্ধ হোই যিব
    -হেলে কণ করা যিব? তার দেহ খরাপসে আগে বঞ্চিব না কাম করিব? কৌনসি মতে সে আজি যাই পারিব নাই
    -ঠিক অছিমু যাই সেই কথা কহিবিকিন্তু কালি ন গলে বহুত খরাপ হোই যিববলে চলে গেল ঘাসিরামমোতিয়াও চলে গেল অন্য কোনো কাজে
    কিন্তু আজ দেরি দেখে দুজন লোককে পাঠিয়ে দিল ঠিকাদারতারা এসে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ডাকাডাকি শুরু করল রামুকেমোতিয়া কাছাকাছি ছিল নাচিৎকার চেঁচামেচি শুনে দুর্বল শরীর নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো রামুইলোকদুটিকে দেখে চিনতেও পারলওখানেই পাথর ভাঙার কাজ করেবলিষ্ঠ দুই জোয়ান
    রামু জিজ্ঞেস করে- কণ হেলা?
    দুজনেই একসঙ্গে বলে ওঠে- তোতে এবে যিবাকু পড়িববাবু ডাকুছি
    -ডাকিবার কণ অছিমোর দেহ ভল নাইমু যাই কণ করিবি? আজি আউ গাড়ি চলাই পারিবি নাই
    -আমে সে সবু জানে নাএমিতি ন গলে ধরি নেবাকু কহিলে
    এ কথা শুনে রেগে গেল রামুবলল- ধরি নেবাকু কহিলা? মোর দেহ ভল নাই, মু কাম করি পারিবি নাই, তথাপি মোতে ধরি নেবাকু হেব? কাহিকি? মু কণ চুরি করিছি কি?
    -বাবু তো সেমিতি কহিলেগোটিএ পম্প্‌ চোরি হোইথিলা আগেন গলে সেই কেস্‌ দেই দেব থানারেআজি বহুত কামপত্থরবালি সর্ট পড়িবনঈরু যেমিতি হেউ আনিবাকু হেব
    -মু পারিবি নাইকেস্‌ দেবে দেউদেহ খরাপ নেই ট্রাক্টর চলাই পারিবি নাই এই খরারে।  বলে ঘরের ভেতর চলে যাচ্ছিল রামুসঙ্গে সঙ্গে লোক দুটো দুপাশ থেকে রামুকে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যেতে লাগলরামুও চেঁচাতে লাগল যাবে না বলেচেঁচামেচি শুনে মোতিয়াও কোথা থেকে দৌড়ে এসে চেঁচিয়ে বলতে লাগল- কণ হেলা রে! কাহিকি ধরি নেউছ রামুকু?
    কিন্তু কোনো কথাই বলল না তারারামুকে জোর করে ধরেই নিয়ে গেলমোতিয়াও কাঁদতে কাঁদতে পেছনে পেছনে ছুটল
    হাঁটাপথে প্রায় আধঘণ্টার পথ রামুকে টেনেহিঁচড়েই নিয়ে গেল লোক দুটি রাধানাথ পট্টনায়কের লোক বলে পথে টুঁ শব্দটিও করল না কেউ
    জরুরি ভিত্তিতে ব্রিজের কাজ চলছে এখানেকাজের সাইটেরাধানাথ পট্টনায়ক নিজেই হাজির থাকে রোজতার সামনেই রামুকে নিয়ে ছাড়ল লোক দুটিটানাহেঁচড়ার পরিশ্রমে এমনিতেই দুর্বল শরীর নিয়ে সেখানেই মাটিতে বসে পড়ল রামু
    রাধানাথের চোখ থেকে তখন ঠিকরে বেরোচ্ছে আগুনের গোলাগর্জন তুলে বলল- আজি তিনদিন হেলা কামরে আসিলু নাইকালি সকালে মু লোক পঠাইথিলি- তাকু ভি ফিরাই দেলু! আজি এত্তে বেলা হেলে মধ্য আসিলু নাইএতে সাহস তোর কেমিতি হেলা?
    -আইগা মোর জ্বর হোইথিলাআসি পারিলি নাইখুব বিনয়ের সঙ্গে বলল রামু
    -জ্বর হোইথিলা? এবে তো আউ জ্বর নাহিএবে কাহিকি আসিলু নাই? তু জানু নাই- তু ন আসিলে কেতে  ক্ষেতি হোই যিব- পথর ন থিবারু কাম বন্ধ হোই যিব
    -আইগা মু কণ করিবি? মোর দেহরে বল নাহিকেমিতি গাড়ি চলাইবি?
    -পুনি মোর মুহ আগরে পাটি করুছ? এতে সাহস তোর? যা, আউ পাটি ন করি গাড়ি নেই চলি যা পথর আনিবাকু
    আইগা কৌনসি মতে মু আজি গাড়ি চলাই পারিবি নাই
    এবারে রাগে ফেটে পড়ল রাধানাথমুখে গালাগাল দিয়ে বলল- চুতিয়া ষড়া, পারিবু নাই বলি পুনি পাটি করুছ মোর সামনারে? কেমিতি পারিবু নাই মু দেখিবিবলে চেয়ার ছেড়ে উঠে গিয়ে ঠাস করে এক চড় বসিয়ে দিল রামুর গালেটাল সামলাতে না পেরে কাত হয়ে মাটিতে পড়ে গেল রামু।  ক্রোধে অন্ধ হয়ে রাধানাথ চুলের মুঠি ধরে দাঁড় করিয়ে দিয়ে ক্রমাগত মারতে থাকল কিল-চড়-ঘুসি।  তারপর ছুঁড়ে ফেলে দিল পাশেই রাখা বালির গাদার উপরতপ্ত বালির উপর পড়ে যন্ত্রণায় ছট্‌ফট্‌ করতে থাকল রামু
    এখানেই রামুর শাস্তির শেষ হল নাদিন আগে এখান থেকেই একটি পাম্প্‌ মেসিন চুরি গিয়েছিলতাতে কাউকে ধরা যায়নিগোপনে গোপনে খোঁজ খবর নেওয়া চলছেরামুকে সে ব্যাপারে সন্দেহ করার মতো কিছু ছিল নাকিন্তু এখন এই অবাধ্যতার শাস্তি দিতে রাধানাথ সেই অপরাধই চাপাল রামুর ঘাড়েকর্কশ কণ্ঠে রামুকে বলল- তু পম্প্‌ চুরি করি কোয়াড়ে রখিলু, কাকু বিকি দেলু, সবু ঠিকঠাক কহিবুন হেলে আজি আউ ঘরে যাই পারিবু নাইষড়া মাইগা, চুতিয়া, তু মোতে জানু নাই! মো কথা উপরে পাটি করুছ!
    রামু কাতর কণ্ঠে হাতজোড় করে বলল- নাই আইগা, মু চুরি করুনিপম্প্‌ চুরি কথা মু কিছি জানে না
    -জানুছ কি নাই মু দেখুছিবলে জগুয়া নামে একজনকে ডেকে বলল- জগুয়া, ষড়াকু লাঙ্গা করি বালি উপরে টানি দে।  দেখুছি সে কেমিতি পম্প্‌ চুরি কথা স্বীকার ন করি পারে
    বলামাত্র জগুয়া নামের বলিষ্ঠ লোকটি এবং আরও দুজন প্রভূভক্ত কুকুরের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ল রামুর উপররামুকে সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে সবাই মিলে চিৎ-কাত-বুট করে নানা কসরত দেখিয়ে সেই তপ্ত বালির উপর টানাহেঁচড়া করতে লাগলসঙ্গে বলতে থাকল পাম্প্‌ চুরির কথা স্বীকার করার জন্য
    কিন্তু রামু যন্ত্রণায় চিৎকার করলেও পাম্প চুরির কথা কিছু জানে না বলা ছাড়া আর কিছুই বলল নাএকটু পরে নিস্তেজ হয়ে নেতিয়ে পড়ল রামুকাতর কণ্ঠে একটু জল খেতে চাইল শুধু
    রাধানাথ চীৎকার করে বলল- ষড়াকু মুতিকিরি পিঁয়াই দে
    সঙ্গে সঙ্গে একজন একটু দূরে গিয়ে নারকেলের মালায় পেচ্ছাপ করে নিয়ে এসে ধরল ওর মুখে।  অন্য দুজন জোর করে ধরে হাঁ করিয়ে খাইয়ে দিল তা
    একটু আগেই ছুটে এসেছিল মোতিয়াসঙ্গে এখানকারই আরও দু-চারজন লোকচুপচাপ সবাই দেখে যাচ্ছিল সবকিন্তু এই দৃশ্য দেখে আর সহ্য করতে পারল না মোতিয়াছুটে এসে ছড়ে পড়ল রাধানাথের পায়ের উপরকাঁদতে কাঁদতে বলল- বাবু তাকু ছাড়ি দিঅতার দেহ খরাপ- জ্বর হেইছিকিছি খাই পারু নাইএমিতি কলে সে মরি যিবমোর রামুকু দয়া কর আইগা- তাকু ছাড়ি দিঅ
    রাধানাথ পায়ের ধাক্কায় সরিয়ে দিল মোতিয়াকেরাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল- ছাড়ি দেবি? ষড়া হারামজাদা, মোর মুহ উপরে পাটি করুছি সেমু তাকু থানারে দেবিতার নারে কেস্‌ করিবি।  পাম্প চুরি করিছি সে
    -নাই আইগা, সে কিছি চুরি করি নাইতার দেহ খরাপসে শুইথিলা ঘরেকাঁদতে কাঁদতে আবার বলল মোতিয়া
    রাধানাথ তেড়ে উঠল মোতিয়ার প্রতিবলল- চুরি করু নাই? তুই তো সইতি রখিথিলু কোয়াড়ে।  পরে বিকি দেলা সেভয়রে আউ কামরে আসু নাই
    -নাই আইগা, সে চুরি করু নাইমু ভি কিছি জানে না
    -ষাড়ী রান্ডি, তু কিছি জানু ন- বলে চুলের মুঠি ধরে মোতিয়ার গালেও বসিয়ে দিল বলিষ্ঠ হাতের এক চড়
    এক চড়েই ঘুরে পড়ে গেল মোতিয়াহঠাৎ চড় খেয়ে উঠে স্তব্ধ হয়ে রইল এক মুহূর্ত সময়।  তারপর সঙ্গে আসা লোকদের প্রতি তাকিয়ে বলল- তমে ঠিয়া হোইকিরি কণ দেখুছ- বাবুকু টিকে বুঝাই কুহ- মোর রামুকু বঞ্চাঅন হেলে তাকু মারি পকাইবসে মরি যিববলে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল মোতিয়া
    চোখের সামনে সব দেখে এবং মোতিয়ার কান্না শুনে কয়েকজন এগিয়ে এলোরাধানাথকে একজন অনুনয় বিনয় করে বলল- আইগা বর্তমান রামুকু ছাড়ি দিয়ন্তুএমিতি খরা ভিতরে বালি উপরে রহিলে সে মরি যিবদয়া করি এবে তাকু ছাড়ি দিয়ন্তু
    রাধানাথ একটু সময় নেতিয়ে পড়া রামুর দিকে তাকিয়ে দেখলতারপর বলল- ঠিক অছি, তাকু এবে ঘরে নেই যাপছরে দেখিবি কণ করা যিব
     কথা শুনে সঙ্গে আসা লোকজনের সাহায্যে পরনের লুঙ্গি জড়িয়ে রামুকে ধরাধরি করে বাড়িতে নিয়ে গেল মোতিয়াতখন ভরা দুপুরসবাই মিলে জল ঢেলে গা ধুইয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল রামুকে।  ভাত চট্‌কিয়ে জল মিশিয়ে খানিকটা নিজের হাতে খাইয়ে দিল মোতিয়াক্লান্ত বিধ্বস্ত রামু যন্ত্রণাকাতর শরীর নিয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল বিছানায়মোতিয়া কাঁদতে থাকল ভাগ্যের প্রতি দোষারোপ করে- অক্ষমতার দোহাই দিয়ে বড়লোকের অত্যাচারের বিচারের ভার ভগবানের উপর ছেড়ে দিয়ে
    কর্মক্লান্ত দিনের শেষে গ্রামের লোকজন এসে জড়ো হলো মোতিয়ার বারান্দায়সমস্ত ঘটনা শুনে এবং রামুর অবস্হা দেখে সবাই বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠলদুর্বল অশিক্ষিত শ্রমিকদের প্রতি শিক্ষিত বড়লোকদের এই অমানুষিক অত্যাচারের একটা প্রতিবাদ অবশ্যই হওয়া দরকার- এ বিষয়ে সবাই একমত হলকারণে অকারণে দলিত মানুষদের প্রতি ক্ষমতাবানদের অত্যাচার যে সীমা ছাড়িয়ে যায় সেটাও অন্তত তাদের মনে করিয়ে দেওয়া দরকারসুতরাং থানায় গিয়ে অন্তত একবার তাদের নালিশটা দায়ের করে আসতেই হবে প্রবল স্বেচ্ছাচারী ঠিকাদার রাধানাথ পট্টনায়কের বিরুদ্ধেএই প্রস্তাবই সাব্যস্ত করল সবাই মিলেসেই মতোই জনাচারেক সঙ্গী নিয়ে মেয়েকে রামুর কাছে রেখে দশ কিলোমিটার দূরের থানার উদ্দেশে রওয়ানা হল মোতিয়া
    কিন্তু থানায় গিয়ে নালিশ করা তো দূরের কথা- বড়বাবুর সঙ্গে দেখাই করতে পারল না মোতিয়ারাগেটের কাছে দাঁড়িয়ে থাকা দুজন কনেষ্টবল আটকে দিল ওদেরসব কথা শুনে হেসেই গড়িয়ে পড়ল তারাবলল, পট্টনায়ক আইগাঙ্ক বিরুদ্ধরে নালিশ করিবা পাঁই আসুছ থানারে? কেতেটা মুন্ড ধরুছ জনে জনে? তারপর ধমক দিয়ে বলল- যাহা কহুছ কহুছ, আউ একথা উচ্চারণ করিবু নাই।  বড়বাবু আইগাঙ্কর সাঙ্গ লোকএক সাঙ্গরে খানাপিনা করুছন্তিআজি রাতিরে ভি আসিবেতার নাঁরে নালিশ করিব জানি পারিলে তমকু ধরি পিটাইবেনালিশ বাহারি যিবআউ কথা না কহি চুপচাপ ঘরে পলাই যাঅবলে সবাইকে ঠেলে বাইরে বের করে দিয়ে থানার গেট বন্ধ করে দিল কনেষ্টবল দুটিহতাশায় ভেঙে পড়ে শুক্‌নো মুখে একপ্রহর রাতে বাড়ি ফিরে এলো সবাই
    এরপরের কাহিনি খুবই সংক্ষিপ্তপরদিন সকাল সকাল উঠে ভাত-তরকারি রান্না করল মোতিয়া।  সকাল নটা নাগাদ স্নান সেরে রামু এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল বারান্দায়মোতিয়া একটা অ্যালুমিনিয়ামের থালায় করে ভাত-তরকারি আর এক হাতে জলের ঘটি নিয়ে এসে সামনে রাখল রামুরহাত ধুয়ে ভাত মুখে দেবে রামুএমন সময়েই দুজন পুলিশকে হেঁটে আসতে দেখে সেদিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল মোতিয়াকাছে আসতেই চিনতে পারল, গতকাল থানার গেটে দেখা সেই কনেষ্টবল দুটিকাছে আসতেই একজন বলল- তু কালি যাইথিলু নাই নালিশ করিবা পাঁই থানারে।  হউ, হেলে ঠিক জাগারে আসিলু আমেরামুকে দেখিয়ে বলল- ই-এ তোর পুঅ রামু কি?
    মোতিয়া বলল- হ আইগাএয়াকু কালি মারিথিলে ঠিকাদারবাবু
    পুলিশটি বলল- কালি কণ হোইথিলা- ঠিকাদারবাবু কণ করিথিলে- সে সবু কথা এবে ছাড়।  পম্প্‌ চুরি করিছি বোলি তার নাঁরে কেস্‌ অছি থানারেতাকু ধরি নেবাকু আমে আসিলুএবে তাকু যিবাকু পড়িব
    এ কথা শুনে কেঁদে ফেলল মোতিয়াবলল- নাই আইগা, সে চুরি করু নাইসবু মিছা কথাসে কিছি জানু নাই
    আর পুলিশটি বলল- সে সবু কথা আমকু কহিলে কণ হেবকোর্টরে যাইকি কহিবু না আউ।  বলেই দুজনে গিয়ে রামুকে উঠিয়ে হাতকড়া পরিয়ে টেনে নিয়ে চলতে শুরু করল
    মোতিয়া কেঁদে গিয়ে সামনে দাঁড়ালবলল- তাকু দিটা ভাত খাইবাকু দিঅকালি কিছি খাই নাই সে 
    পুলিশটি বলল খাইবার সময় হেব নাইএবে বস্‌ আসি যিব- আমে বসরে পলাই যিবুএহি বস্‌টা চালি গলে পাঁচ ঘন্টা ভিতরে আউ বস্‌ নাহিবলেই মোতিয়াকে হাত দিয়ে সরিয়ে রামুকে টেনে নিয়ে বারান্দা থেকে নেমে হাঁটতে শুরু করল তারা
    সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে ছাড় খেয়ে পড়ল মোতিয়াসেই ভাতের থালার উপর মাথা কুটে চিৎকার করে কেঁদে কেঁদে বলতে থাকল- মহাপ্রভু মোর রামুকু বঞ্চাই দিঅমহাপ্রভু তমে বিচার কর ---
    মোতিয়ার কান্নাভেজা নিষ্ফল চিৎকার বাতাসেই মিলিয়ে যেতে থাকল শুধু
    (একটি সত্য ঘটনা অবলম্বনে লেখা)


  • 0 comments:

    Post a Comment

    100%