শ্রমমন্ত্রী ও আইনমন্ত্রী
বাবাসাহেব ডঃ বি.আর. আম্বেদকর
সুধীর রঞ্জন হালদার
হিন্দু-ভারতে বর্ণবাদী
হিন্দুদের পরিচালিত সমস্ত সংবাদ মাধ্যম এবং বর্ণহিন্দু শিক্ষিত তথা বুদ্ধিজীবী মহল
বর্ণহিন্দুদের মধ্যে কারও সদগুণ বিশিষ্ট সামান্যতম কাজেরও এত ফলাও করে প্রচার করে
যে, সে যেন বিশাল একটা কিছু করে ফেলেছে। চতুর্দিক তার জয়জয়কারে মুখরিত হয়ে ওঠে। সে
একজন মহামানবে পরিণত হয়ে যায়। তার জঘন্য কাজের হাজারো নিদর্শন থাকলেও তা প্রচার
করে না। পক্ষান্তরে তথাকথিত নিম্নবর্ণ বা অবর্ণ হিন্দুদের কেউ সমাজসেবা বা দেশের
কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করতে প্রাণান্ত হয়ে গেলেও তার নামগন্ধ কোথাও প্রচার করে না।
মানুষে তার মহৎ কাজের কথা জানতেই পারে না। উপরন্তু তার যদি সামান্যতম দোষত্রুটি
খুঁজে পায়, সেটাকেই কারণে অকারণে প্রচার করে। এটাই বর্ণবাদী তথা মনুবাদী
ভারতবর্ষের চরিত্র।
বাবাসাহেব ডঃ ভীমরাও রামজী
আম্বেদকরের বেলায়ও ঘটেছে ঠিক তাই। তিনি জীবিত থাকাকালীন সময়ে তাঁর কাজকর্মের
প্রচারও ঠিক মনুবাদী চরিত্র অনুযায়ীই হয়েছে, তাঁর ভাল কাজেরও কীভাবে মন্দ দিকটা
খুঁজে বের করা যায় সেই চেষ্টাই হয়েছে, নয়তো দায়সারাভাবে খবর প্রকাশিত হয়েছে। এখনও
সেই ধারা সমানভাবে চলছে। বাবাসাহেবের জন্মদিনকে জাতিসংঘ জ্ঞানদিবস হিসাবে ঘোষণা
করায় বিশ্বের দেশে দেশে আম্বেদকরের জন্মদিনটি উৎসাহ-উদ্দীপনার সাথে জ্ঞানদিবস
হিসাবে পালিত হচ্ছে। আম্বেদকর সম্পর্কে পত্রপত্রিকায় নানা লেখালেখি হচ্ছে। কিন্তু
তাঁর জন্মভূমি এই ভারতবর্ষে বিশেষ করে আমাদের এই বাংলায় ওই দিনটি সম্পর্কে দু-একটি
বাক্যও চোখে পড়েনি বিখ্যাত সব পত্রপত্রিকার পাতায়। সরকারি পর্যায়ে কোথাও কোথাও
বাবাসাহেবের প্রতিকৃতিতে মালা চরিয়ে অনুষ্ঠান সারা হয়েছে মাত্র। যদিও আম্বেদকর
অনুরাগী বিভিন্ন তপশিলি জাতি-উপজাতির মানুষেরা ভারতের সর্বত্র সাড়ম্বরে তাঁর
জন্মদিন ও প্রয়াণদিবস পালনের মাধ্যমে তাঁকে স্মরণ করে থাকে, তথাপি সেসব খবরও কোনো
পত্রপত্রিকা প্রকাশ করে না।
সমস্ত সংবাদ মাধ্যমের এই যে
প্রচারের ধরণ, এর ফলে বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের মধ্যে বিশেষ
কোনো ধারণার জন্মই হয়নি। বাবাসাহেবের কাজকর্ম সবই দলিত বা নির্যাতিত শ্রেনির
মানুষদের কল্যাণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল এবং তিনি নির্যাতিত শ্রেণির জনগণেরই নেতা
ছিলেন, তিনি সংবিধান রচনায় অংশগ্রহণ করে তপশিলি জাতির জন্য রাজনীতি, শিক্ষা ও
চাকরির ক্ষেত্রে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করে গিয়েছেন, এমনই একটি ধারণা সমগ্র ভারতবাসীর
মনে গাঁথা হয়ে আছে ওইসব প্রচারযন্ত্রের কূটকৌশলে। শুধু এটুকুই তো নয়, তিনি নাকি
স্বাধীনতারও বিরোধী ছিলেন! তপশিলি জাতির মানুষদের মধ্যে কিছু কিছু শিক্ষিত লোকেরা
বাবাসাহেব ডঃ আম্বেদকর সম্পর্কে কিছু কিছু জানলেও অধিকাংশ শিক্ষিত লোকেরা
বাবাসাহেব সম্পর্কে কিছুই জানেন না। গ্রামের সাধারণ নিরক্ষর মানুষের তো কথাই নেই।
শিক্ষিত লোকেরা যেটুকুও বা জানেন তা ওই মনুবাদী প্রচারযন্ত্রের মাধ্যমেই জানেন।
সবচেয়ে দুঃখের কথা যাঁরা জানেন না, তাঁরা বাবাসাহেব সম্পর্কে জানার চেষ্টাও করেন
না।
যাই হোক,
আমার প্রবন্ধ লেখার উদ্দেশ্য, বাবাসাহেব ডঃ বি.আর.আম্বেদকর যে শুধুমাত্র তপশিলিদের
নেতা ছিলেন এ কথাটি সর্বৈব মিথ্যা, তিনি ছিলেন একজন জাতীয় নেতা, এই কথাটি প্রকাশ
করা। বাবাসাহেব ছিলেন খাঁটি দেশপ্রেমিক এবং সমগ্র মানবজাতির স্বাধীনতার প্রতীক। তিনি
তাঁর কাজকর্মের মধ্যে সব সময়ই প্রাধান্য দিয়েছেন দেশের কল্যাণসাধনে ও দেশের
মানুষের কল্যাণ কামনায়। কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব নয়, দেশের সমস্ত মানুষ যাতে সমান
অধিকার এবং সমান সুযোগসুবিধা পায় সেটাই ছিল তাঁর প্রচেষ্টা। সেই সমান অধিকার
পাওয়ার জন্যই অধিকারহীনদের অধিকার প্রাপ্তির প্রচেষ্টা স্বভাবতই তাঁকে করতে হয়েছে।
এজন্যই তপশিলি জাতি ও তপশিলি উপজাতির জন্য বিশেষভাবে কিছু ব্যবস্থা রাখার প্রয়াসও
তাঁকে করতে হয়েছে। এটা কোনো সম্প্রদায়ের প্রতি পক্ষপাতিত্ব নয়, সমান অধিকার আনার
প্রচেষ্টা মাত্র।
১৯৪২
খ্রিস্টাব্দের ২০ জুলাই ডঃ আম্বেদকর ব্রিটিশ সরকারের ভাইসরয়ের (Viceroy) অধীন মন্ত্রীসভায় শ্রমমন্ত্রী (Labour
Member) নিযুক্ত হন। প্রকৃতপক্ষে ওই
বছরের ২৭ জুলাই তিনি দিল্লি গিয়ে পরদিন থেকে তাঁর দপ্তরের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
ওই পদে তিনি ১৯৪৬ সালের মে মাস পর্যন্ত বহাল ছিলেন। ওই সময়ে নির্বাচিত
প্রতিনিধিদের নিয়ে নতুন সরকার গঠিত হলে পুরোনো সরকারের সমাপ্তি ঘোষণা করা হয়।
প্রায় চার বছর তিনি ওই পদে বহাল ছিলেন।
এরপর
১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হলে জহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে গঠিত প্রথম মন্ত্রীসভায়
ডঃ আম্বেদকর আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ১১ অক্টোবর ‘হিন্দু
কোডবিল’ পাশ করাতে না পেরে প্রতিবাদ স্বরূপ তিনি পদত্যাগ করেন। এরপর তিনি বিরোধী
নেতা হিসাবে সংসদে ছিলেন।
এখন দেখা
যাক, ডঃ আম্বেদকর এই যে দু’বার মন্ত্রীপদে ছিলেন সে সময়ে তিনি কী কী কাজ করেছিলেন।
ব্রিটিশ সরকারের অধীন মন্ত্রীসভার শ্রমমন্ত্রী হিসাবে তিনি যেসব কাজ করেছিলেন তার
কিন্তু কোনোটাই শুধু মাত্র তপশিলি জাতি বা দলিত মানুষের জন্য করেননি। তার
প্রত্যেকটি কাজ ছিল সাধারণ খেটে খাওয়া শ্রমিকদের জন্য, যার মধ্যে সমস্ত জাতিবর্ণের
লোকই রয়েছেন। তার মধ্যে কয়েকটি নিচে উল্লেখ করা হলোঃ-
১) Joint
Labour Management Committee- সরকার, মালিক ও শ্রমিকদের মধ্যে বিরোধের
ক্ষেত্রে শান্তিপূর্ণ আলোচনার জন্য আগেই আম্বেদকরের পূর্বসূরি স্যার ফিরোজ খাঁ
নুনের সময়ে Tripartite Labour Conference-এ একটি Standing Labour Committee গঠন
করা হয়েছিল। বম্বে সেক্রেটারিয়েটে ১৯৪৩ সালের ৭ মে আম্বেদকরের সভাপতিত্বে ওই
কমিটির তৃতীয় সভায় এই কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়। এই কমিটিতে কারখানা পরিচালনায়
শ্রমিকদের প্রতিনিধি রাখার সংস্থান রাখা হয়।
২) Employment
Exchange- ওই একই সভায় ভারতে প্রথম শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ করার জন্য Emploment
Exchange গঠন করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এর ফলে ইচ্ছামতো মামা-কাকার জোরে
শ্রমিক-কর্মচারী নিয়োগ প্রথা বন্ধ হয়; প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত দক্ষ এবং আধা-দক্ষ
শ্রমিক-কর্মচারী যারা Employment Exchange-এ নাম লিখিয়েছেন তাঁদের ভেতর থেকেই
নিয়োগ করা বাধ্যতামূলক করা হয়।
৩) Trade
Union- ভারতের সর্বত্র বিভিন্ন অফিস, কলকারখানা ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে শ্রমিক
ইউনিয়ন থাকলেও আইনগতভাবে সেগুলির কোনো সরকারি স্বীকৃতি ছিল না। ডঃ আম্বেদকরের প্রচেষ্টায়ই
সর্বপ্রথম সেগুলিকে স্বীকৃতি দেওয়ার উদ্দেশ্যে ‘ভারতীয় শ্রমিক সমিতি (সংশোধনী)
বিল’ পাশ হয়। এর ফলে শ্রমিক-কর্মচারীদের Trade Union করার অধিকার আইনসঙ্গত হয়।
৪) কাজের
সময়সীমা বেঁধে দেওয়া- আগে শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজের সময়ের কোনো সময়সীমা ছিল
না। ১০ থেকে ১৪/১৬ ঘন্টা পর্যন্ত কাজ করতে হত। এজন্য তাঁদের কোনো বাড়তি মজুরি
দেওয়া হত না। ডঃ আম্বেদকরই এই সময়সীমা ৮ ঘন্টায় বেঁধে দেন। এর অতিরিক্ত কাজ করালে
তার জন্য Over-time Salary দেবার আইন পাশ করেন।
৫) Labour
Investigation Committee- শ্রমিক শ্রেণির বেতন, খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান,
শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয় পর্যালোচনা করা এবং তার সুষ্ঠু ব্যবস্থা
করার জন্য এই কমিটি গঠন করেন এবং এ বিষয়ে বিভিন্ন আইন প্রণয়ন করেন। সেগুলির মধ্যে
শ্রমিক ও তাঁদের পরিবারের সদস্যদের সরকারি খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য E.S.I
Hospital সৃষ্টি করা। এ ছাড়া শ্রমিকদের সরকারি খরচে প্রশিক্ষণ দেওয়ার আইনও তিনি করে
যান।
৬) Coal
Mine Labour Welfare Fund Ordinance- শ্রমমন্ত্রী ডঃ আম্বেদকর কয়লাখনির
শ্রমিকদের আর্থিক উন্নয়ন করার উদ্দেশ্যে এই আইন পাশ করেন।
৭) The
Factories Amendment Bill- আগে শিল্প-কলকারখানায় কর্মচারীদের সাপ্তাহিক ছুটির
দিন ছাড়া আর কোনো সবেতন ছুটির ব্যবস্থা ছিল না। কেউ অনুপস্থিত থাকলে তার বেতন কাটা
যেত। শ্রমমন্ত্রী ডঃ আম্বেদকর এই আইন পাশ করে কলকারখানার প্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক
কর্মচারীদের বছরে ১০ দিন এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক শ্রমিক-কর্মচারীদের ১৪ দিন সবেতন ছুটির
ব্যবস্থা করেন।
৮) নারী-পুরুষের
সমহারে বেতন- আগে পুরুষ শ্রমিকদের তুলনায় মহিলা শ্রমিকদের বেতন কম ছিল। ডঃ আম্বেদকর
আইন করে এই বৈষম্য দূর করেন। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একই কাজের জন্য একই বেতনের আইন
তিনি পাশ করেন।
৯) মাতৃত্বকালীন
ছুটি- আগে সন্তান জন্ম দেওয়া ও তার প্রতিপালনের জন্য নারী শ্রমিকদের বেতন ছাড়া
ছুটি নিতে হত। ডঃ আম্বেদকর সন্তান প্রসবের আগে ১০ সপ্তাহ এবং প্রসবের পরে ৬
সপ্তাহের সবেতন ছুটির আইন পাশ করেন।
১০) Protection
of Minimum Wage Bill- ডঃ আম্বেদকরের মন্ত্রীত্বের শেষের দিকে আর একটি
গুরুত্বপূর্ণ বিল এনেছিলেন। কিন্তু সেই বিলটি তিনি পাশ করিয়ে যেতে পারেননি। বিলটি
ছিল ‘সর্বনিম্ন বেতনের নিরাপত্তা বিল’। এতে বলা হয়েছিল শ্রমিকদের বেতন
নির্ধারণের ক্ষেত্রে একটি অ্যাডভাইসরি বোর্ড ও একটি অ্যাডভাইসরি কমিটি থাকবে। এতে
থাকবে মালিক ও শ্রমিকপক্ষের সমসংখ্যক সদস্য। তাদের সুপারিশে শ্রমিকদের সর্বনিম্ন
বেতন ধার্য হবে। এই বিলটি দু’বছর পরে স্বাধীনোত্তরকালে জগজীবন রাম শ্রমমন্ত্রী থাকার
সময় পাশ হয়।
এখানে
উল্লেখিত যে আইনগুলি শ্রমমন্ত্রী থাকাকালে ডঃ আম্বেদকর বিধিবদ্ধ করে গেছেন, তার
কোন আইনটি শুধুমাত্র তপশিলি জাতির জন্য করেছেন? সবগুলিই জাতিধর্মবর্ণনির্বিশেষে
সমস্ত দেশবাসীর কল্যাণের জন্য করেননি কি?
এরপরে
স্বাধীন ভারতের আইনমন্ত্রী থাকাকালে তিনি যা যা করেছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য
হলো খসড়া সংবিধান কমিটির চেয়ারম্যান হিসাবে সংবিধান রচনা করা। অনেকে বলেন, ডঃ
আম্বেদকর একা সংবিধান রচনা করেননি, আরও অনেক সদস্য ছিলেন, সবাই মিলে সংবিধান রচনা
করেছেন। এই ধারণাটি সম্পূর্ণ ভুল এবং উদ্দেশ্য প্রনোদিত। সংবিধান রচনার উদ্দেশ্যে
যে কমিটি গঠিত হয়েছিল (Drafting Committee) তার সদস্যরা হলেন- এন.মাধবরাও, সৈয়দ
এম.সাদুল্লাহ্, স্যার আল্লাদি কৃষ্ণমাচারি, টি.টি.কৃষ্ণমাচারি এবং অন্য আরও দু’জন।
ডঃ আম্বেদকর হলেন কমিটির চেয়ারম্যান। এই সাতজনের মধ্যে একজন সদস্য পদত্যাগ করেন; তবে
তার জায়গায় অন্য একজনকে নেওয়া হয়েছিল। একজন মারা গিয়েছিলেন। একজন চলে যান আমেরিকা।
এই দু’জনের জায়গায় কাউকে নেওয়া হয়নি। একজন ব্যস্ত ছিলেন সরকারি কাজে। দু’জন ছিলেন
দিল্লি থেকে অনেক দূরে। অসুস্থ থাকায় তাঁরা সভায় হাজির হতেও পারতেন না। সুতরাং শেষ
পর্যন্ত সংবিধান রচনার দায়িত্ব একা ডঃ আম্বেদকরের উপরেই এসে পড়ে। এই খবরটি
জানিয়েছেন কমিটির সদস্য টি.টি.কৃষ্ণমাচারি তার গণপরিষদে দেওয়া ১৯৪৮ সালের ৫
নভেম্বর তারিখের ভাষণে। এছাড়া কমিটির সভায় কোনো কোনো দিন ডঃ আম্বেদকর ও তাঁর
সেক্রেটারি ছাড়া আর কোনো সদস্য উপস্থিতও হতেন না। ঠিক এই কারণেই ডঃ আম্বেদকরকে
সংবিধানের রূপকার বলা হয়।
দুর্জনেরা
যাই বলুক, প্রায় একার দায়িত্বেই ডঃ আম্বেদকর রাতদিন পরিশ্রম করে সংবিধান রচনা
করেছিলেন। এরও আগে ২২ জুলাই গণপরিষদে ভারতের বর্তমান অশোকচক্র শোভিত গৈরিক, সাদা ও
সবুজ এই ক্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা গৃহীত হয়। গান্ধির প্রস্তাবিত চরকা শোভিত
ত্রিবর্ণ পতাকাকে বাতিল করা হয়। এর পেছনেও ছিল ডঃ আম্বেদকরের যুক্তি ও অবদান।
সাম্যের প্রতীক অশোকচক্রকেই তিনি প্রাধান্য দিয়েছিলেন। এজন্য অবশ্য গান্ধি খুবই
মর্মাহত হয়ে অভিমানও করেছিলেন!
তবুও ডঃ
আম্বেদকর ও তাঁর সহকর্মীরা ইচ্ছামতো সংবিধান রচনা করতে পারেননি। এ প্রসঙ্গে খসড়া
কমিটির সদস্য এম.সাদুল্লাহ্ বলেছিলেন যে, কমিটি সব সময় নিজেদের ইচ্ছা ও বিবেচনা
অনুযায়ী কাজ করতে পারেননি, কংগ্রেসের প্রভাবশালী নেতাদের পরামর্শ অনুসারে তাঁদের
চলতে হয়েছে। গণতন্ত্রের নীতিবিরুদ্ধ কিছু কিছু ধারা উচ্চতম নেতৃত্বের ইচ্ছায়
সংবিধানে সংযোজিত করতে হয়েছে। ডঃ আম্বেদকর সমাজতান্ত্রিক নীতিকে মৌলিক অধিকার
হিসাবে সংবিধানে স্থান দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ধনিক শ্রেণি পরিচালিত কংগ্রেসের
জন্য তা করা সম্ভব হয়নি। ফলে শ্রমজীবী মানুষদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারগুলিকে সরকারের
নির্দেশমূলক অধিকারের মধ্যে রাখা হয়। সরকারের মর্জি হলে তবেই তা কার্যকর করা সম্ভব
হয়। এর মধ্যে আছে- সমস্ত নাগরিকের জীবিকার অধিকার, জাতীয় আয়ের সুষ্ঠু বন্টন, পুঁজিবাদ
বিরোধী ব্যবস্থা, নারী-পুরুষের সমান অধিকার, ১৪ বছর বয়স পর্যন্ত ছেলেমেয়েদের
বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা, তপশিলি, আদিবাসী ও অনুন্নত শ্রেণির উন্নয়নের
ব্যবস্থা, পঞ্চায়েত ব্যবস্থা প্রবর্তন ইত্যাদি।
আইনমন্ত্রী
থাকাকালীন ডঃ আম্বেদকর বিশেষভাবে যে আইনগুলি প্রণয়নের জন্য যে বিলটি সংসদে উত্থাপন
করেছিলেন সেটি হল ‘হিন্দু কোড বিল’। গোঁড়া হিন্দু সদস্যদের বিরোধিতার জন্য
বিলটি সংসদে পাশ করানো সম্ভব হয়নি। তারই প্রতিবাদে ডঃ আম্বেদকর নেহরু-মন্ত্রীসভা
থেকে পদত্যাগ করেন। কী কী ছিল সেই বিলে, যার জন্য গোঁড়া হিন্দু সদস্যরা ক্ষিপ্ত
হয়ে বিলটিকে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন- সেটাই এখন দেখা যাক।
আসলে
‘হিন্দু কোড বিল’-এর কাজ শুরু হয়েছিল ব্রিটিশ সরকারের আমলে। ১৯৪১ সালে স্যার
বি.এন.রাওয়ের সভাপতিত্বে হিন্দু-আইন সংশোধন করা এবং তা আইন হিসাবে লিপিবদ্ধ করার
জন্য একটি কমিটি গঠিত হয়। কমিটি সারাদেশ ঘুরে বিভিন্ন মতামত সংগ্রহ করে তার
ভিত্তিতে হিন্দু কোড বিলের একটি খসড়া তৈরি করে। ১৯৪৬ সাল থেকে বিলটি আইন-পরিষদের
বিচার্য বিষয় হিসাবে ছিল। স্বাধীনতার পর বিলটির দায়িত্ব পরে ডঃ আম্বেদকরের উপর।
তিনি বিলটির আমূল পরিবর্তন করে নতুন বিলে পরিণত করেন।
এই বিলে
যা যা ছিল তার কয়েকটি হচ্ছেঃ-
১) বাল্যবিবাহ
রদ- নারীশিক্ষার স্বার্থে মেয়েদের বিয়ের বয়স সর্বনিম্ন ষোলো বছর করা।
২) বহুবিবাহ
প্রথার বিলোপ- কোনো কারণ ছাড়া ইচ্ছামতো এক স্ত্রী থাকতে দ্বিতীয়বার বিয়ে করা
যাবে না।
৩) বিবাহবিচ্ছেদ
আইন- স্বামী বিনা কারণে ইচ্ছামতো স্ত্রীকে ত্যাগ করতে পারবে না। আবার স্ত্রীও
অত্যাচারী বা ব্যভিচারী স্বামীকে পরিত্যাগ করতে পারবে।
৪) মেয়েদের
পিতার সম্পত্তিতে অধিকার- ডঃ আম্বেদকর ছেলেদের মতো মেয়েদেরও পিতৃসম্পত্তিতে
সমান অধিকারের ব্যবস্থা করেন এই বিলে।
৫) বিধবা
নারীর সম্পত্তি ও দত্তক নেবার অধিকার- মৃত স্বামীর সম্পত্তিতে স্ত্রীর অধিকার
দেওয়া হয় এই বিলে এবং ইচ্ছামতো দত্তকও নিতে পারবে।
ডঃ
আম্বেদকরের এই চিন্তাধারার মধ্যে সমগ্র হিন্দু নারীদের মুক্তির বার্তা ছাড়া আর কী
আছে? রাজা রামমোহন রায় ও ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের পর হিন্দু নারীদের প্রতি অন্যায়
ব্যবহার নিয়ে আর কোন হিন্দু নেতা এমন ভেবেছিলেন? বহু প্রগতিশীল মানুষ এই বিলের
প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন। এমনকি প্রধানমন্ত্রী নেহরু পর্যন্ত এই বিল পাশ না হলে
পদত্যাগ করবেন বলে বড়াইও করেছিলেন। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী পত্রপত্রিকায় এর বিরূপ
সমালোচনায় ডঃ আম্বেদকরকে তীব্র ভাষায় আক্রমণ করা হয়। হিন্দুধর্মের প্রতি প্রবল
আক্রমণ বলে এই বিলে গোঁড়া হিন্দুরা ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। অগত্যা প্রধানমন্ত্রী
নেহরুর নির্দেশেই বিলটিকে প্রত্যাহার করা হয়। চাচা নেহরুর বড়াই-এর বেলুন চুপসে যায়।
চাচাজির পদত্যাগের পরিবর্তে, প্রতিবাদে ডঃ আম্বেদকরই পদত্যাগ করেন।
হিন্দু
কোড বিল পরবর্তীকালে পাশ হয়েছে; এসব আইনও হয়েছে অনেকদিন, মেয়েরা সেসব অধিকার ভোগও
করছে। কিন্তু তারা জানে না তাদের এই অধিকার দানের মূল হোতা বাবাসাহেব ডঃ ভীমরাও
রামজী আম্বেদকর।
------------
তথ্যসূত্রঃ- "Dr.
Ambedkar: Life And Mission", Dananjay Keer.
0 comments:
Post a Comment