দণ্ডকারণ্য ও
নারী-সমাজ
সুধীর রঞ্জন
হালদার
মোটামুটিভাবে মুষ্টিমেয় উচ্চবর্গীয় কিছু
ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজনৈতিক নেতার ষড়যন্ত্র ও খেয়ালখুশিতে দেশভাগের কাজটি সম্পন্ন
হয়েছে। পরিতাপের বিষয় এই যে, ভারতের সাধারণ জনতা,
বিশেষ করে নিম্নবর্গীয় মানুষেরা তার বিন্দুবিসর্গও জানতে পারেনি। অথচ দেশভাগের
পরিণামে তারাই পড়েছে সব থেকে বেশি সংকটে। যত দুর্যোগ-দুরবস্থা, অত্যাচার-অপমানের
শিকার তারাই হয়েছে। উচ্চবর্গীয় মানুষেরা অনায়াসে একদেশ থেকে অন্য দেশে গিয়ে
যথারীতি আগের মতোই সহায়-সম্পদ নিয়ে বহাল তবিয়তে স্থিতিলাভ করেছে।
এই যে দেশভাগ এবং তজ্জনিত কারণে বহু বছর ধরে
দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন সময়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছে, তাতে যেমন লক্ষ
লক্ষ লোকের প্রাণহানী ঘটেছে, তেমনি ইজ্জতও গিয়েছে লক্ষ
লক্ষ নারীর। হাজার হাজার নারী অপহৃতা হয়ে মুসলমান হয়ে যেতে বাধ্য হয়েছে। জোরপূর্বক
তাদেরকে ইসলামধর্মে ধর্মান্তরিত করা হয়েছে। এছাড়া অনেকে সপরিবারেও মুসলমান হতে
বাধ্য হয়েছে। এই যে ধর্মান্তরণ- এটা কিন্তু হয়েছে একতরফা। কারণ, হিন্দুধর্মের
বাধ্যবাধকতার কারণে অন্য ধর্মের কাউকে ওই ধর্মে ধর্মান্তরিত করে স্থান দেওয়া যায়
না।
এ সমস্ত অত্যাচার ও ভবিতব্যের কথা চিন্তা করেই
শিক্ষাদীক্ষায় উন্নত উচ্চবর্গীয় হিন্দুরা, বিশেষ করে পাকিস্তানের
পূর্বভাগের (বর্তমান বাংলাদেশের) বামুন-কায়েত-বদ্যিরা আগেভাগেই দেশত্যাগ করে
ভারতের অপেক্ষাকৃত কম জনবসতিপূর্ণ পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শহর ও শহরতলীতে বসতি
স্থাপন করে স্থিতিলাভ করেছে। কিন্তু শিক্ষাদীক্ষাহীন নিম্নবর্গীয় হিন্দুরা,
যাদের অধিকাংশ ভূমিহীন কিংবা অল্প সামান্য জমির মালিক, চাষবাসই যাদের
একমাত্র জীবিকা- তারা অনেক অন্যায়-অত্যাচার সহ্য করেও দিশাহীনভাবে অনির্দিষ্টের
পথে পা বাড়াতে সাহস করেনি। কিন্তু মাঝে মাঝেই রাষ্ট্রীয় মদতে অত্যাচারের মাত্রা
সীমা ছাড়িয়ে যেতে অনেকটা দেরী করে হলেও, তারাও ধীরে ধীরে অধিক
সংখ্যায় দেশত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। তারা সম্পূর্ণ অসহায়- নিজস্ব শক্তিতে কোথাও স্থায়ী হওয়ার মতো অবস্থা
তাদের নয়; তারা সম্পূর্ণভাবে সরকারের উপর নির্ভরশীল। কিন্তু তাদের
জমিজায়গা দিয়ে পুনর্বাসন দেবার মতো পর্যাপ্ত উদ্বৃত্ত জমিও সেই মুহূর্তে সরকারের
হাতে ছিল না। তাই ভারত সরকার তাদের ঠাঁই দিয়েছে বিভিন্ন অস্থায়ী শিবিরে।
প্রথমদিকে এই শিবিরগুলি ছিল পশ্চিমবঙ্গে এবং
অল্পকিছু কৃষক পরিবারকে পশ্চিমবঙ্গে পুনর্বাসনও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী সময়ে
কোনো অজ্ঞাত কারণে পশ্চিমবঙ্গে আর উদ্বৃত্ত জমি নেই- এই অজুহাতে ভারতের বিভিন্ন
রাজ্যে ওই কৃষক পরিবারগুলিকে পুনর্বাসন দেবার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। আসলে ভারতের
রাজনৈতিক নেতাদের এইসব চাষি পরিবারগুলিকে পশ্চিমবঙ্গে পুনর্বাসন দেবার কোনো ইচ্ছাই
ছিল না। তারও কারণ ছিল রাজনৈতিক। আবার এই যে অন্যান্য রাজ্যগুলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
বিচ্ছিন্নভাবে তাদের পুনর্বাসন দেওয়া হবে, সেই সিদ্ধান্ত নিতেও বহু
বছর লেগে যায়। বলতে গেলে হাজার হাজার উদ্বাস্তু পরিবারকে বছরের পর বছর অলস
জীবনযাপন করে ওই উদ্বাস্তু শিবিরে কাটাতে বাধ্য করা হয়।
আবহমান কাল থেকে যারা সমাজবদ্ধভাবে পূর্ববঙ্গে
গ্রাম্যজীবনে বসবাস করে এসেছে, হঠাৎ তারা আধাশহরে
উদ্বাস্তু শিবিরে এসে অনেকটা ছন্নছাড়া হয়ে যায়। কারণ, যাদের সঙ্গে এ
যাবত বসবাস করে এসেছে সেইসব প্রতিবেশী, আত্মীয়স্বজন বা আপনজনেরা
কেউই তো একসঙ্গে এদেশে আসেনি। পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পরস্পরের অপরিচিত
বিভিন্ন আচার-আচরণের মানুষগুলি নতুনভাবে পাশাপাশি বাস করতে গিয়ে আগেকার সেই
সমাজবন্ধন অনেকটা শিথিল হয়ে পড়ে। এ ছাড়া শিবিরজীবনে সামান্য ডোলের টাকায় সংসার
নির্বাহ করাও কঠিন ছিল। এজন্য অনেক পরিবারের নারীরাও বিভিন্ন টুকিটাকি যেমন-
বিড়িবাঁধা, ঠোঙা বানানো ইত্যাদি কাজে নেমে পড়তে বাধ্য হয়।
পূর্ববঙ্গে থাকাকালীন যে নারীরা ছিল অন্তর্মুখী, গৃহকর্মে নিমগ্ন-
যাদের বাড়ির বাইরে যাওয়াও ছিল নিন্দনীয়, তারাই এদেশে এসে
প্রয়োজনের তাগিদে বহির্মুখী হয়ে পড়তে বাধ্য হয়। এরপর যখন পশ্চিমবঙ্গের বাইরে
বিভিন্ন রাজ্যে ও কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন দণ্ডকারণ্যে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা
করা হবে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, তখন তাদের ভারতের
অন্যান্য প্রদেশের শিবিরগুলিতে নিয়ে রাখা হয়। এসময় আবার পুরোনো শিবিরে থাকা
প্রতিবেশীদের কাছ থেকেও পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। এই নতুন শিবিরগুলিতেও তাদের
বছরের পর বছর কাটাতে হয়েছে। তখন ভিন্ন পরিবেশে উদ্বাস্তুদের মধ্যে সমাজের বন্ধন
একেবারেই ভেঙে পড়ে।
এইসমস্ত শিবিরে বাস করার সময়েও নারীদের
বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হতে হয়। সংসারের সুরাহা করার কাজে পুরুষের সঙ্গে সমানভাবে
ভূমিকা পালন করতে গিয়ে অনেক নারী বিপথগামিনী হতেও বাধ্য হয়। কিন্তু সেসব আমার
আলোচ্য বিষয় নয়- আমার আলোচ্য বিষয় দণ্ডকারণ্যে পুনর্বাসিত নারীদের নিয়ে। সে প্রসঙ্গেই
এখন আসব।
দণ্ডকারণ্যে পুনর্বাসনপ্রাপ্ত প্রত্যেকটি
পরিবার তাদের জন্য নির্দিষ্ট গ্রামে যখন পৌঁছেছে, তখন তাদের বাস
করতে হয়েছে তাঁবুতে। সেই তাঁবু খাটাবার ব্যবস্থা অবশ্য পরিবারগুলি পৌঁছাবার আগেই
সরকার থেকে করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু একটি মাত্র তাঁবুর ভিতরে অনেক সদস্যযুক্ত
পরিবারের পক্ষে রাত্রিবাস ও খাওয়াদাওয়া করা ছিল খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। ওই
তাঁবুটি বেশিদিনের জন্যও নয়, সেটি খুলে নিয়েই আবার
টাঙানো হবে অন্য গ্রামে নতুন আসা বাসিন্দাদের জন্য। তাই খুব কম সময়ের মধ্যে তাদের
নিজেদের বানিয়ে নিতে হয়েছে অস্থায়ী একটি থাকা-খাওয়ার ঘর। এগুলি ছিল ঝাটিমাটির ঘর।
জঙ্গল থেকে বল্লি কেটে খুঁটি বানিয়ে ঘাসপাতার ছাউনি দিয়ে চটজলদি তৈরি। ডালপালা এনে
বেড়া বানিয়ে তার দুই পাশে জলমাটি পায়ে দলে ছেনে, সেই কাদামাটি
লিপে তৈরি হয়েছে ঘরের দেয়াল। একরকম কুড়েঘর আর কি! তো সেই ঘর বানাতে ঘরামি কোথায়
পাবে- মজদুর কোথায় পাবে? সব পরিবারকেই তো একই
সঙ্গে বানাতে হয়েছে এই ঘর! সুতরাং নিজেরা যেমন পারো, তেমনি করো। তাই
একাজেও এগিয়ে আসতে হয়েছে নারীকেই। পুরুষের সঙ্গে সমানে মাটি কাটা, জল আনা, সমস্ত শ্রমিকের
কাজ করতে হয়েছে। অবশ্য মজুরি হিসাবে সরকার এজন্য ধার্য কিছু টাকা দিয়েছে। তার নাম
ছিল ‘হাটমেন্ট গ্রান্ট’। নইলে কী খেয়ে কাজ করবে এরা!
এরপর যখন সরকারি কণ্ডাক্টর স্থায়ী ঘর করে
দিয়েছে, সে ঘর ছিল খুঁটির উপরে টিনের চালা দেওয়া শুধুই একটি কাঠামো
মাত্র। তাতে থাকার জন্য কামরা তৈরি, ঘরের দেয়াল দেওয়া,
দরজা-জানালা লাগানো- সবই তো করতে হয়েছে যার ঘর তাকেই, অর্থাৎ সেই
পরিবারকেই। সেই বড়ো ঘরের চারদিকে দেয়াল, আলাদা আলাদা কামরা করলে
তার দেয়াল- এগুলি করা কম শ্রমসাধ্য এবং কম সময়ের ব্যাপার নয়। সেখানেও মাটি কাটা,
দূরের টিউবওয়েল চেপে জল আনা, মাটি ভিজিয়ে ছানা,
তারপরে দেয়াল বানানো। এসব কাজে পুরুষের তুলনায় নারীদের ভূমিকাই ছিল বেশি। আমার
মনে হয়- পূর্ববঙ্গের গ্রাম্য নারীরা সমস্ত ধরনের গৃহকর্ম করে বটে- তবে এসব কাজের
কথা আজ অবধি কল্পনাও করতে পারে না। এসব কাজেও মজুরি হিসাবে দেয়াল মেপে পয়সা দিয়েছে
সরকার। এটাই ছিল সে সময়কার সংসার চালানোর একমাত্র উপায়- ডোলের টাকা দেওয়া তো
গ্রামে আসার কয়েকদিনের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল।
এবারে চাষবাসের বিষয়টা দেখা যাক। মনে রাখতে হবে,
দণ্ডকারণ্য প্রকল্পে বাঙালি উদ্বাস্তুদের কৃষক পরিবারগুলির পুনর্বাসনের জন্য
যে এলাকা নির্দিষ্ট করা হয়েছিল, সেই এলাকার সবটাই ছিল
পাহাড়পর্বত ও জঙ্গলে পরিপূর্ণ। তার মধ্যে বিভিন্ন জায়গার মাটি পরীক্ষা করে
চাষযোগ্য জমির সন্ধান করে সেইসব এলাকার জঙ্গল পরিষ্কার করে বানানো হয়েছে
উদ্বাস্তুদের গ্রাম ও চাষের জমি। পরিষ্কার করা অর্থে প্রাচীনকাল থেকে
প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো বিশাল বিশাল মহীরুহসহ বনজঙ্গলকে বুলডোজারের সাহায্যে
ভূপাতিত করে একদিকে ঠেলে নিয়ে গিয়ে রাশিকৃত করে রাখা মাত্র। এরপর সেই ফাঁকা জমিকে
চাষযোগ্য করে তুলতে যা যা করণীয় তা ওই পরিবারগুলিকেই করে নিতে হয়েছে। লটারি করে
প্রত্যেক পরিবারকে জমি ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। লটারি কেননা, সব জমি সমান নয়,
কোনোটা উৎকৃষ্ট তো কোনোটা নিকৃষ্ট। কোনোটা গ্রামের কাছে, কোনোটা অনেক দূরে
অবস্থিত। কিন্তু প্রথম অবস্থায় কোনো পরিবারের একজনের পক্ষে ওই জমিকে চাষ করে ফসল
ফলানো সম্ভব ছিল না বলে প্রথমদিকে চাষ হয়েছে গ্রুপ পদ্ধতিতে। বিশ-পঁচিশটা পরিবার
মিলে এক-একটা গ্রুপ করে সবাই মিলে তাদের জমিতে চাষ করেছে। ফসল হলে সবাই ভাগ করে
নিয়েছে। অবশ্য সে চাষ হয়েছে নমো নমো করে। ভাগের মা গঙ্গা পায় না, তাই আর কী! নানা
সমস্যা দেখা দিয়েছে তাতে। কেউ কম পরিশ্রম করতে পারে, কেউ বেশি। কেউ সময়ে কাজে আসে তো কেউ আসে না ইত্যাদি।
সুতরাং এরপরে যার জমি সে নিজেই আলাদা হয়ে চাষ করেছে।
দণ্ডকারণ্যে চাষ মানেই বর্ষার জলে চাষ। বর্ষার
জল ছাড়া ফসল ফলাবার আর কোনো উপায় নেই। কিন্তু পার্বত্য এলাকার ভূমি সর্বত্রই
একদিকে ঢালু। বর্ষার জল সে ভূমিতে একটু সময়ও দাঁড়ায় না। পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই হু হু
করে বয়ে যায় নিচের দিকে। একটু পরেই মাটি আবার শুকিয়ে যায়। সুতরাং জমিতে জল ধরে
রাখার ব্যবস্থা করা চাই। এজন্য জমিকে ছোটো ছোটো প্লটে ভাগ করে সমতল করে শক্ত করে
আল বাঁধতে হয়; তবেই সেই জমিতে জল দাঁড়াবে। এ ছাড়া আছে বহু
বছরের পুরোনো বিশাল মহীরুহের শিকড় মাটির গভীরে, সেগুলি লাঙলে
বাধে, তা থেকে প্রতি বছর নতুন করে গাছও গজিয়ে ওঠে। জমিতে ঘন ঘন
আলবাঁধা আর গাছের শিকড় তোলার কাজ করতে হয় গাঁইতি-কোদাল চালিয়ে।
দণ্ডকারণ্যের মাটি পূর্ববঙ্গের মাটির মতো নরম
পলিমাটি নয়, শুকনো শক্ত মাটি। কোথাও কাঁকুড়ে, কোথাও মোরাম,
কোথাও বা বালি মিশ্রিত মাটি। গাঁইতি-কোদালই এই মাটি কাটার উপযোগী যন্ত্র। একটি
পরিবারের একজন পুরুষ লোকের পক্ষে কোদাল-গাঁইতি চালিয়ে জমিকে সমতল করে ঘন ঘন আল
বাঁধা আর গাছের শিকড় তোলা কোনোক্রমেই সম্ভব ছিল না। সুতরাং এক্ষেত্রে ঘর ছেড়ে বের
হয়ে আসতে হয়েছে নারীকে। পুরুষের সঙ্গে সমানে সমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই জমিতে
খাটতে হয়েছে ঘরের গৃহিণীকে। যে নারী পূর্ববঙ্গে ছিল গৃহকর্মে নিযুক্ত, ঘরবাড়ি
পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে গুছিয়ে রাখা, আর পরিবার-পরিজনদের
সুখস্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি লক্ষ রাখাই ছিল যাদের কাজ, চাষের জমি কোথায়
কেমন সে খবরও জানত না যে নারী, দণ্ডকারণ্যে এসে তারাই
হয়েছে জমিতে খেটে জমি উদ্ধার করা কাজের মজদুর। অনেক ক্ষেত্রে এমনও দেখা গিয়েছে,
যেখানে দুর্বল পুরুষের সাথে রীতিমতো হালচাষও করতে হয়েছে নারীকে। হঠাৎ স্বামী
মরে যাওয়া সদ্য বিধবাদের তো ঘরেবাইরে সমানেই খাটতে হয়েছে। অবশ্য যে পরিবারে
কর্মক্ষম পুরুষের সংখ্যা একাধিক ছিল, সেই পরিবারের নারীকে হয়তো
এসব কাজে নামতে হয়নি। কিন্তু তেমন পরিবার খুব অল্পই ছিল।
এই প্রসঙ্গে একটি কথা বলা বোধ হয় অসঙ্গত হবে না
যে, সরকারি ব্যবস্থাপনার জেরে কৃষিজীবী পরিবারগুলির যে সব যুবক
বয়সিরা পূর্ববঙ্গে ছিল অভিজ্ঞ চাষি, তারাই বছরের পর বছর
পশ্চিমবঙ্গে এবং অন্যান্য রাজ্যের শিবিরগুলিতে থাকাকালীন সময়ে নিষ্কর্মা বসে বসে
তাস পিটিয়ে বয়স বাড়িয়ে হয়েছে প্রৌঢ়- শক্তিহীন, কাজের অভ্যাসও
চলে গিয়ে হয়ে পড়েছে অলস। আর যারা ছিল শিশু-কিশোর, পুনর্বাসন
ক্ষেত্রে যাবার সময় তারা হয়েছে যুবক, যাদের চাষ করার কোনো
অভিজ্ঞতাই জন্মেনি। এর ফলেও চাষবাসের কাজে অনেকটা অসুবিধায় পড়েছে চাষি পরিবারগুলি।
গ্রামের কৃষক পরিবারে গোরু-ছাগল পোষা একটি
অনিবার্য ঘটনা। সেটা পূর্ববঙ্গেও ছিল দণ্ডকারণ্যে এসেও হয়েছে। কিন্তু দণ্ডকারণ্যে
গোরু-ছাগল পুষতে তার সঙ্গে রাখাল থাকা ছিল অবশ্যিক। ছাগলের জন্য যেমন বুনো জন্তুর
ভয়, তেমনি এক পাহাড়ের আড়ালে চলে গেলে সেখান থেকে নতুন গোরু পথ
চিনে আর ফিরে আসতে পারে না গোয়ালে। চাষের সময় ফসলে মুখ দেবে এজন্যও চাই রাখাল।
নয়তো না খেয়ে থাকবে গোরু-ছাগল। বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠে তো ঘাসের চিহ্নও থাকে না মাঠেঘাটে।
তখন পাহাড়ের কোলে জঙ্গলের গাছ-লতাপাতা খাইয়ে পেট ভরাতে হয় গোরু-ছাগলের। এজন্য
অবশ্যই যেতে হবে গোরু-ছাগল চরাতে। সেখানে অগত্যা নারীকেই যেতে হয়েছে অনেক
ক্ষেত্রে। বিশেষ করে দশ-বারো বছরে ছেলে বা মেয়ে যা-ই হোক, তাকে তো
গোরু-ছাগল চরাতে যেতেই হয়েছে শতকরা নব্বইটি পরিবারেই। পাহাড়-জঙ্গলে একসাথে গোরু
চরাতে গিয়ে এর ফলে কিশোরী বয়সেই নষ্ট হয়েছে অনেক মেয়ে।
নতুন পত্তন হয়েছে দণ্ডকারণ্যের সব গ্রাম। নতুন
মাটি, জলের অপ্রতুলতায় নতুন আবহাওয়াতে অনভ্যস্ত চাষে ফসল তেমন ফলে
না। সরকারি সাহায্যও নেই। ফসল ওঠার তিনমাস-ছ’মাস পরেই আর অন্ন নেই ঘরে শতকরা
সত্তর-আশি পরিবারে। পুরুষ-নারী অনেককেই তখন যেতে হয়েছে বাইরের সরকারি ঠিকাদারের
বিভিন্ন কাজে মজদুর হয়ে- মাটিকাটা, পাথরভাঙা, রাজমিস্ত্রির
যোগানদার ইত্যাদি। এ কাজের জন্য অভ্যস্ত ছিল না কেউই- নারীরা তো নয়ই। তবু পেটের
দায় বড়ো দায়। সেই পেট চালাতে ছোট্ট ছেলেমেয়েদের মুখে অন্ন তুলে দিতে বাধ্য হয়ে
মজদুরের কাজ করতে হয়েছে নারীকেও। সেই কাজ করতে গিয়ে পা ফেলতে হয়েছে তাদের ঘরের
বাইরে। আর বাইরে ওৎ পেতে থাকা কত হায়েনার দল- তাদের শিকার হতে হয়েছে এই অসহায়
নারীদের। এর ফলেও পদস্খলন হয়েছে অনেক নারীর।
দণ্ডকারণ্যের গ্রামে যেসব সরকারি কর্মচারীরা
থাকতেন তাদের মধ্যে ছিলেন শিক্ষক, গ্রামসেবক, ফার্মাসিস্ট,
চৌকিদার, কৃষিকর্মী ইত্যাদি। শিক্ষক তো প্রায় প্রতি
গ্রামেই ছিলেন এক-দুজন করে। গ্রামসেবক তিন-চারটে গ্রাম মিলিয়ে একজন, ফার্মাসিস্টও
তেমনি। চৌকিদার, কৃষিকর্মী এরা ছিলেন বিশেষ বিশেষ গ্রামে। এদের
সবাই গ্রামেই সরকারি কোয়ার্টারে থাকতেন। এঁদের মধ্যে বয়স্করা কেউ কেউ পরিবার নিয়ে
থাকতেন। বেশির ভাগই ছিলেন অবিবাহিত- অল্পবয়সি যুবক। অনেকে আবার পরিবার ছাড়াও
থাকতেন। এদের প্রত্যেকেরই কাজের মেয়ে দরকার। অল্পবয়সিরা রান্নাবান্না জানে না,
থালাবাসন ধুতে পারে না, জামাকাপড় পরিষ্কার করতে
জানে না। পরিবার নিয়ে যারা থাকেন তাদেরও অনেক কাজ। সুতরাং কাজের মেয়ে তাদের
প্রত্যেকেরই চাই। কোথায় মিলবে কাজের মেয়ে?
যেখানে বছরের বারোমাসই অভাব লেগে আছে, ছেলেমেয়ের মুখে
অন্ন তুলে দিতে ঘরের নারীকেও বাইরে যেতে হয় মজদুরি করার কাজে, সেই পরিস্থিতিতে
গ্রামের মধ্যেই যদি সরকারি বাবুদের ঘরে কাজ করে দুটো পয়সা আসে তবে তাই বা মন্দ
কী!। সুতরাং বাবুদের কাজের মেয়ের অভাব হয় না। সামান্য বেতনের বিনিময়ে জুটেই যায়
অনায়াসে। আর বিভুঁই বিদেশে এই জঙ্গলে এসে একটানা বিনোদনহীন থেকে একলা ঘরে একজন
যুবতী মেয়ে কিংবা বউকে কাজ করতে দেখে কতদিন আর উপোসি থাকবেন বাবুরা! এভাবেও নষ্ট
হয়েছে অনেক মেয়েবউ।
দণ্ডকারণ্য প্রকল্পে সরকারি কর্মীদের মধ্যে
বিভিন্ন প্রদেশের বিভিন্ন ভাষাভাষী লোক থাকলেও গ্রামের কর্মীরা কিন্তু অধিকাংশ
বাঙালি ছিলেন। তবে বাঙালি হলেও তারা বেশিরভাগ ছিলেন বামুন-কায়েত এবং পশ্চিমবঙ্গ
থেকে আগত। বামুন-কায়েত সহ অন্য যারা ছিলেন তারাও প্রায় সকলেই উদ্বাস্তু
পরিবারগুলিকে খুবই ঘেন্না করতেন। উদ্বাস্তু পরিবারগুলি যেন তাঁদের কাছে ইতর কোনো
প্রাণী এমন ব্যবহারই তাদের সঙ্গে করতেন। উদ্বাস্তু নারীদের ইজ্জত তাঁদের কাছে ছিল
একটা খেলার সামগ্রী- তার কোনো মূল্যই ছিল না তাঁদের কাছে। সামান্য কিছু পয়সার
বিনিময়ে বা কখনও এমনিতেই তাদের ভোগ করাটা কোনো ব্যাপারই নয়, এমন মানসিকতা ছিল
তাঁদের। অবাঙালি কর্মচারীরাও বাঙালি কর্মচারীদের দেখাদেখি উদ্বাস্তুদের
সম্পর্কে একই মনোভাব পোষণ করতেন। উপরন্তু
উদ্বাস্তু রমণীদের প্রতি তাঁরা একটা আলাদা আকর্ষণ অনুভব করতেন।
সেবকবাবু ছিলেন গ্রামের সর্বেসর্বা।
উদ্বাস্তুদের কাছে তিনি তখন খুদে ভগবান। তাঁর সুপারিশেই একটি পরিবার চাল-আটা,
কৃষিসরঞ্জাম কিংবা অন্য কোনো সরকারি সাহায্য পাবে কি পাবে না, তা নির্ভর করত।
কোনো কোনো সেবকবাবুকে এজন্য খুশি করার একটা বিষয় ছিল। কোনো রুগ্ন স্বামীর যুবতী
স্ত্রী কিংবা বিধবা কোনো নারীর উপর বর্তাতো এই খুশি করার ব্যাপারটা। সেবকবাবুর
অবাধ্য হলে কারো আর উপায় ছিল না। নানাভাবে হয়রান হতে হতো তাকে।
আগেই বলেছি দণ্ডকারণ্যে এসে উদ্বাস্তু
পরিবারগুলির মধ্যে সামাজিক বন্ধন প্রায় সম্পূর্ণ ভেঙে পড়েছিল। শুধু সামাজিক বন্ধন
ভেঙে পড়াই নয়, সেইসঙ্গে নষ্ট হয়ে গিয়েছিল বাঙালির ভাষা,
সংস্কৃতি, মূল্যবোধ ও নৈতিকতাও। গ্রামগুলির পরিবেশও আর
ভালো ছিল না। প্রতিবেশীদের মধ্যে কেউই পূর্বপরিচিত বা আপনার জন নয়। বিভিন্ন জেলার
বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এসে পাশাপাশি ঘর বেঁধেছে সবে। তখনও কেউ কাউকে আপনার বলে ভাবতে
পারেনি। বরং ভিন্ন অঞ্চলের বলে পরস্পরের প্রতি একটা হেয়ভাব প্রকাশ করার মানসিকতা
ছিল। তাই কার ঘরে কী কেচ্ছা হচ্ছে তা নিয়ে কুৎসা রটনা করা ছাড়া আর কোনোভাবে মাথা
ঘামাবার মতো তত প্রচেষ্টা ছিল না কারো। নারীদের সঙ্গে অনৈতিক ক্রিয়াকর্ম নিয়ে
বিরাট কিছু অঘটন না ঘটলে অন্যান্যরা তাতে মাথা গলাতো না। মোটকথা সকলের মানসিকতাতেই
একটা বিরাট পরিবর্তন এসেছিল- নিজের সমস্যা নিয়েই তখন সবাই ব্যস্ত ছিল।
আশেপাশের আদিবাসী গ্রামগুলিতে তৈরি হতো
মহুয়াফুল থেকে দেশীয় মদ। এখানে মহুয়া গাছের ছড়াছড়ি। মহুয়া একটি অর্থকরী ফসলও
এখানে। যেমন তার ফুলের দাম তেমনি ফলেরও। মহুয়ার রসই এখানে প্রাচীনকালের সোমরসের
স্থান করে নিয়েছে। বাঙালি যুবকরাও এখানে এসে অভ্যস্থ হয়ে উঠল সেই সোমরস- মহুয়ামদের
নেশায়। নেশার ঘোরে কুবুদ্ধিও চাপল অনেকের মাথায়। গ্রামেরই যুবতী মেয়েবউদের দিকে কুদৃষ্টিও পড়ল অনেকের। এ
নিয়েও গ্রামবাসীদের মধ্যে কেচ্ছাকাহিনির অন্ত ছিল না তখন। ‘কারো বউ নিয়ে গেছে অন্য
একজন’- এমন খবর পাওয়া যেত মাঝে মাঝেই। দেশে থাকতে সামাজিক শৃঙ্খলায় এসমস্ত কেউ
কল্পনাও করতে পারত না কখনো।
এমন পরিস্থিতির মধ্যে থেকে হঠাৎ এলো সুন্দরবনে
যাবার হিড়িক। তাতে যোগ দিয়ে আর একবার উদ্বাস্তু হলো দণ্ডকারণ্যের বাসিন্দারা।
উদ্বাস্তু হয়ে পথেঘাটে অনির্দিষ্টের মাঝে জীবনযাপন মানেই নারীদের অবমাননা, ইজ্জত হারানোর
কাহিনি। তবুও সুন্দরবনের মরিচঝাঁপিকে বাসযোগ্য করে তুলতে পুরুষের সঙ্গে সমস্ত কাজে
সমানে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করে গিয়েছে নারীরা। রাস্তাঘাট তৈরি, বসতবাড়ি নির্মাণ,
বাজার-হাটে- প্রত্যেকটি ক্ষেত্রে নারীরাও সমানভাবে অংশ নিয়েছে। কিন্তু
উদ্বাস্তুদরদি সেজে যে রাজনৈতিক দলগুলি তাদের নিয়ে আগে রাজনীতি করেছে, ক্ষমতাসীন হয়ে
ডেকে নিয়ে গিয়েছিল তাদের, সেই দলগুলিই
বিশ্বাসঘাতকতা করে পুলিশ দিয়ে, ক্যাডারবাহিনী দিয়ে
পিটিয়ে, গুলি করে তাড়িয়ে দিয়েছে তাদের। তাতে যেমন হতাহত হয়েছে
অগুণতি পুরুষ, তেমনি হয়েছে নারীরাও। এর পরেও দণ্ডকারণ্যে ফিরে
এসে আরও যে কত নারীর ইজ্জত হারানোর সঙ্গে সঙ্গে নিঃস্ব হয়ে যাবার ঘটনা আছে তা বলে
শেষ করা যায় না।
আমি এক মহিলার কথা জানি, যার কাহিনিটি অতি
সংক্ষেপে এখানে উল্লেখ করলে বোধ হয় অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সে যখন প্রাইমারি স্কুলে
পড়ে (বিভিন্ন উদ্বাস্তু শিবিরে থাকার ফলে একটু বেশি বয়সেই পড়ালেখা করতে হয়েছে তাকে
শুধু নয়, অনেককেই), তখন তার শিক্ষক পড়ানোর
নাম করে নিজের ঘরে ডেকে নিয়ে প্রথম তার ইজ্জত নষ্ট করে। কিশোরী অবস্থায় নানাভাবে
বুঝিয়ে ফুসলিয়ে সেই শিক্ষক অনেকবারই এ ঘটনা চালিয়ে যায়। ফলে মেয়েটি গর্ভবতী হয়ে
পড়ে। পারিবারিক ভাবে অনেক চেষ্টায় তা থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়। কিন্তু গ্রামের
মধ্যে জানাজানি হয়ে গেলে মেয়েটির নামে দুর্নাম রটে। এর ফলে মেয়েটিকে নানজনের কাছ
থেকে নানা কটুকথা শুনতে হয়। তবু সে সমস্ত এড়িয়ে মেয়েটি ঐকান্তিক চেষ্টায় হোস্টেলে
থেকে হাইস্কুলের পড়ালেখা চালিয়ে যায়।
মেয়েটির বুড়ো বাপ আগেই মারা গিয়েছিলেন। তিনটে
ভাইয়ের বড়োটি বিয়ে করে আলাদা। আর দুটো ভাইয়ের ছোটোটি বিয়ে করে শহরে গিয়ে থাকে। এক
গ্রীষ্মের ছুটিতে ছোটো দাদার বাড়িতে শহরে গিয়ে থাকে মেয়েটি তার বউদির বাচ্চা
সমালানোর কাজে সাহায্য করতে। বউদি একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেয় তার সঙ্গে বিয়ে
দেবে বলে। ছেলেটিও তাকে বিয়ে করবে বলে কথা দিয়ে অবাধ মেলামেশা করে। বউদির
প্ররোচনাতেই এসব করতে মেয়েটি একরকম বাধ্যই হয়। এরও পরিণাম বিষময় হয়। মেয়েটি আবার
গর্ভবতী হয়ে পড়লে ছেলেটি পালিয়ে চলে যায় পশ্চিমবঙ্গে। এভাবেই দ্বিতীয়বার নষ্ট হয়
মেয়েটি।
এরপর মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে হঠাৎ মেয়েটির মা
মারা যান। মেজভাই যেমনি অলস, তেমনি মদো-মাতালও। তবু মা
তাকে জোরজার করে সঙ্গে নিয়ে মাঠে চাষবাসের কাজ করাতেন। সেই মা মারা যাওয়াতে মেয়েটি
অথৈ জলে পড়ে, পড়ালেখা ঠিকমতো করতে পারে না আর। মাধ্যমিক
পরীক্ষা দিয়েও পাশ করতে পারে না সে। তার চেয়ে ছ-বছরের ছোটো হাইস্কুলে পড়া একটি
বোনও এখন তার দায়িত্বে। এই তিনজনের সংসার এখন। ছোটোবোন খুবই সুন্দরী। গ্রামের উঠতি
বয়সের ছেলেরা অনেকেই তাকে বিরক্ত করে। অনেক যুবকও তাকে বিয়ে করার জন্য পাগল হয়ে
ওঠে। নিজে বড়ো হয়েও তার নামে যে কলঙ্ক রটেছে তাতে তার বিয়ে হওয়া দুষ্কর, তদুপরি সে দেখতেও
কালো। সুতরাং নিজের জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনার কথা ভেবে মেয়েটি ছোটোবোনটির বিয়ের
ব্যবস্থা করে। নয়তো ওকে বাঁচানোও সম্ভব হবে না কামোন্মত্ত পুরুষের লালসা থেকে।
ছোটোবোনটির বিয়ের পর দাদা আর বোনের সংসার চলতে থাকে। গোরুচরানোর কাজ থেকে শুরু করে
দাদার সঙ্গে মেয়েটিও মাঠে গিয়ে চাষের কাজে সহযোগিতা করতে বাধ্য হয়। তাদের নিজস্ব
আত্মীয়স্বজন কে কোথায় আছেন, নৈনিতাল না আন্দামানে,
তার খবরও জানে না মেয়েটি বা তার দাদারা কেউই।
এরপর অনেক চেষ্টার পরে মেয়েটি অঙ্গনওয়াড়ি
কর্মীর কাজ পায়। গ্রামের কাছেই এক আদিবাসী গ্রামে তার ডিউটি পড়ে। কাজের প্রথমদিনেই
তার সাক্ষাৎ হয় পঞ্চায়েৎ অফিসের সেক্রেটারির সাথে। তার সই দরকার কাজে যোগ দিতে
হলে। সে একজন ওড়িয়া ব্রাহ্মণ- বয়স পঞ্চান্ন-ছাপ্পান্ন হবে। ওই গ্রামে সে একা থাকত
একটি ঘরে। এক রুগ্ন আদিবাসীর যুবতী স্ত্রী কাজ করত তার ঘরে এবং নির্বিবাদে সে তাকে
ভোগ করত। শহরে তার বাড়িতে দশজন ছেলেমেয়ে নিয়ে দ্বিতীয় পক্ষের স্ত্রী থাকত। এদিকে
ওই আদিবাসী যুবতীর গর্ভেও তার ঔরসে এক পুত্রসন্তান আছে। তাকে সে বাইরে হোস্টেলে
রেখে পড়াত।
এই মেয়েটির পদস্খলনের কথা সে জানত তার চেনাজানা
বাঙালি বন্ধুদের কাছ থেকেই। সুতরাং মেয়েটি সহজলভ্য হবে ভেবে নিয়ে সেদিন থেকে সে
তার পিছু লাগতে শুরু করে। ছলছুতোয় নানা কারণ দেখিয়ে যখন তখন সে মেয়েটিকে ডেকে
পাঠায়, একথা সেকথা বলে কুপ্রস্তাব দেয়। এ ব্যাপারেও গ্রামেরই
কয়েকজন বাঙালি যুবক প্ররোচনা দিয়ে ওই লোকটিকে সহায়তা করে। সে লোকটিও যখন তখন মদ
খেয়ে নেশা করে অবস্থা আরও জটিল করে তোলে। শেষে অবস্থা এমন এমন দাঁড়ায় যে, মেয়েটি নিজের
সম্মান রক্ষার্থে লোকটির কুপ্রস্তাবে সাড়া দিতে বাধ্য হয়। মাঝে মাঝে তার ঘরে রাত
কাটাতেও হয়। কোনো অজুহাতে দূরের শহরে গিয়েও কাটিয়ে আসে কিছুদিন। ইতিমধ্যে লোকটির
দ্বিতীয়পক্ষের স্ত্রী হঠাৎ মারা যায়। এতগুলি ছোটো ছোটো ছেলেমেয়ে নিয়ে লোকটি বিপদেই
পড়ে। প্রথমপক্ষের স্ত্রী আগেই মারা গিয়েছিল। তার মতো বয়সের একজন প্রৌঢ়ের সঙ্গে
তৃতীয়পক্ষে বিয়ে দেবার মতো কুমারী মেয়ে পাওয়া, বিশেষ করে ওড়িয়া
ব্রাহ্মণসমাজে আর সম্ভব নয় বুঝে লোকটি তখন মেয়েটিকে বিয়ে করার প্রস্তাব দেয়।
মেয়েটি এমনভাবে তখন তার জালে জড়িয়ে পড়েছে যে, তা থেকে মুক্তি
পাবার আর কোনো উপায় খুঁজে পায় না। তাদের সম্পর্কের কথাও লোকমুখে জানাজানি হয়ে
গেছে। মেয়েটি বাধ্য হয়ে রাজি হয়। কিন্তু সে ওড়িয়া ব্রাহ্মণ এতই চতুর যে
সামাজিকভাবে শাস্ত্রমতে বিয়ে করতে রাজি নয়। কারণ হিসাবে মেয়েটিকে বোঝায় যে,
শাস্ত্রমতে সামাজিকভাবে বিয়ে করে তার দু-দুবার বউ মরেছে, সুতরাং এবার কোনো
মন্দিরে গিয়ে মালাবদল করে বিয়ে করবে। এই বলে মেয়েটিকে নিয়ে অনেক দূরের কোনো শহরের
মন্দিরে গিয়ে মালাবদল করে বিয়ের অভিনয় করে। সামাজিকভাবে কোনো অনুষ্ঠান না করেই
এরপর পাকাপাকিভাবে তাকে নিয়ে ঘরে তোলে এবং শহরের বাড়িতে থাকা ছোটো ছোটো
ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসে মানুষ করার ভার দেয়। মেয়েটি তার ঘরে একরকম রক্ষিতার মতোই
থেকে তার ছেলেমেয়েদের মানুষ করে। সেইসঙ্গে লোকটির ঔরসজাত আদিবাসীর গর্ভে জন্মানো
ছেলেটিকেও কাছে রেখে নিজের ছেলের মতো মানুষ করে। কেননা সে ছেলেটির মাও কী একটা
রোগে হঠাৎ মারা যায়। যখন মেয়েটি তার ঘরে যায়, তখন তার বয়স
মাত্র তেইশ এবং লোকটির বয়স ছাপ্পান্ন বছর। সবচেয়ে করুণ যেটা সেটা হলো, এরপর মেয়েটির
গর্ভে যতবারই সন্তান এসেছে, ততবারই নানা অজুহাতে
মিথ্যা বুঝিয়ে মেয়েটিকে দূরের প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে গিয়ে অ্যাবার্শন করিয়ে
এনেছে এবং শেষবার অ্যাবার্শনের সময় মেয়েটিকে না জানিয়ে ডাক্তারকে সন্তান রয়েছে বলে
মিথ্যাচার করে চিরস্থায়ী বন্ধ্যাত্বকরণ করিয়ে নিয়েছে- যাতে এই মেয়েটির মতো
নিচজাতির কারো গর্ভে তার পিতৃপরিচয়ে কোনো সন্তান না জন্মায়। মেয়েটি যখন জানতে
পেরেছে, তখন তার কান্না ছাড়া আর কিছু করার ছিল না। আদিবাসী মহিলাটির
গর্ভে জন্মানো ছেলেটির পিতৃপরিচয় লোকটিকে বহন করতে হয়নি। কেননা, সে স্ত্রীলোকটির
স্বামী রুগ্ন হলেও তখন জীবিত ছিল।
এরপর বছর বারোর মতো সে লোকটি বেঁচে ছিল। পরে
ক্যান্সার হয়ে সে মারা যায়। ইতিমধ্যে তার ছেলেমেয়েরা বড়ো হয়ে যায়। বড়ো ছেলেরা
কাজকর্ম করে আয় করতে শেখে। তারা সবাই মেয়েটিকে ছেড়ে চলে যায় তাদের শহরের বাড়িতে।
মেয়েটি একা পড়ে থাকে সেই আদিবাসী গ্রামে আদিবাসীর গর্ভে জাত ছেলেটিকে নিয়ে। তখন
মেয়েটির বয়স মাত্র পঁয়ত্রিশ বছর!
তবু সেই আদিবাসী ছেলেটিকে আঁকড়েই চলছিল মেয়েটির
জীবন। যা কিছু তার সঞ্চয়-উপার্জন- ওই ছেলেটির পেছনেই খরচ করে তাকে দাঁড় করাবার
চেষ্টা করে সে। অবশেষে উপযুক্ত হলে নিজে দেখেশুনে তাকে বিয়েও দেয়। কিন্তু বিয়ের
পরে এক-দেড় বছরের মধ্যেই সেও বউ নিয়ে আলাদা হয়ে তার আসল বাড়িতে ফিরে যায়। মহিলাটি
এখন সম্পূর্ণ একা নিঃস্ব অবস্থায় সামান্য অঙ্গনওয়াড়ি-কর্মী হয়ে কোনোরকমে জীবন
নির্বাহ করে। কখনো সুযোগ পেলে ওই ছেলেবউয়ের দুটি বাচ্চা শিশুকে নাতিনাতনি বলে ডেকে
এনে কোলে নিয়ে আদর করে- নাচায়, এটাসেটা কিনে দেয়- আর
দুধের সাধ ঘোলে মেটায়। আর ওই ছেলেটি- এখনও ঠেকায় পড়লে ছুটে আসে ওই মহিলার কাছে-
তার কাছে এসেই হাত পাতে সে। দয়ার শরীর মমতাময়ী নারী- নিজের না থাকলেও চেয়েচিন্তে
ধার করে এনে তার যথাসর্বস্ব দিয়ে ওই ছেলের চাহিদা মিটায়!
তাহলে, এই হলো একটি মেয়ের
সংক্ষিপ্ত জীবন কাহিনি, যার সবটাই ঘটেছে দেশভাগের ফলে উদ্ভূত
পরিস্থিতিতে আত্মীয়-পরিজনহীন অবস্থায় দণ্ডকারণ্যের নতুন পরিবেশে বসবাস করতে গিয়ে।
এ ঘটনা নিয়ে বৃহৎ এক উপন্যাস রচনা করা যায়। এই মেয়েটির মতো আরও অনেক মেয়েরই করুণ
পরিণতি ঘটেছে এই দণ্ডকারণ্যে এসে- যার মূলে রয়েছে দেশভাগ।
এতক্ষণ যা বর্ণনা করেছি তা অতীতের কথা। দেশভাগ
হয়েছে আজ থেকে তিয়াত্তর বছর আগে। ইতিমধ্যে বিশ্বে অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। তারই সূত্র
ধরে পরিবর্তন ঘটেছে দণ্ডকারণ্যে পুনর্বাসনপ্রাপ্ত বাঙালিদের ক্ষেত্রেও।
দণ্ডকারণ্যে বসবাসের দীর্ঘ ষাট-বাষট্টি বছরে ধীরে ধীরে হলেও বহু বদলে গিয়েছে
এখানকার বাঙালি-জনজীবন ও তাদের আর্থ-সামাজিক চিত্রটিও। দণ্ডকারণ্যের সমস্ত
এলাকাগুলির প্রশাসনিক সমস্ত দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট রাজ্যসরকারের কাছে হস্তান্তরিত করা
হয়েছে তাও অনেক বছর হয়ে গেল। দণ্ডকারণ্য নামটাও ধীরে ধীরে মুছে যাচ্ছে এখানকার
মানুষের মন থেকে। এখনকার নতুন প্রজন্ম দণ্ডকারণ্য নামের মানেও জানে না। বাঙালি
হয়েও এখানে কী করে এসেছে, কেন এসেছে তারা তাও অনেকে
জানে না। এখানটাকেই তারা তাদের জন্মভূমি বলে জেনে এসেছে। আগে যেসব জায়গায়
দণ্ডকারণ্য প্রকল্পের অফিসগুলি ছিল, সেসব জায়গার নাম ‘ডিএনকে’
এলাকা বলেই তারা জানে। কিন্তু ‘ডিএনকে ছক’, ‘ডিএনকে ফুটবল
মাঠ’, ‘ডিএনকে দুর্গামণ্ডপ’ ইত্যাদি নামে জানলেও ‘ডিএনকে’ যে
দণ্ডকারণ্য-এর সংক্ষিপ্ত রূপ তা তারা অনেকেই জানে না।
এখন চাষবাসের অনেক উন্নতি হয়েছে। চাষের জমিকে
ছোটো ছোটো প্লটে ভাগ করে আল বেঁধে সমতল করা সম্পূর্ণ হয়েছে। বর্ষার জল অনেকদিন
জমিতে ধরে রাখা যাচ্ছে। বিভিন্ন জায়গায় দণ্ডকারণ্য প্রকল্পের দ্বারা যেসব বাঁধ
তৈরি হয়েছিল, সেগুলি থেকে এখন জলসেচের ব্যবস্থা হয়েছে। এছাড়া
রাজ্য সরকারগুলির সহায়তায়ও বিভিন্নভাবে জলসেচের ব্যবস্থা করা হয়েছে। চাষিরা
নিজেদের জমিতে পুকুর কেটে জল সঞ্চয় করে মোটরের সাহায্যে জলসেচের ব্যবস্থা নিজেদের
উদ্যোগেই করে নিয়েছে। বহু জমিতে এখন দু-বার ফসল ফলছে। বাঙালি চাষিরাও এখানকার
আবহাওয়া অনুযায়ী চাষবাসে অভ্যস্থ হয়ে উঠেছে। উচ্চফলনশীল জাতের বীজ ব্যবহার করে
ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। শাকসবজি উৎপাদন, মৎস্যচাষ
ইত্যাদিও এখন বারোমাসই সম্ভব হচ্ছে। এর ফলে এখানকার পুনর্বাসনপ্রাপ্ত বাঙালি
পরিবারগুলির অর্থনৈতিক অবস্থার যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
এছাড়া বাঙালিরা ব্যবসাবাণিজ্য ইত্যাদিতেও যথেষ্ট উন্নতি করেছে। লেখাপড়া শেখার ব্যাপারেও যথেষ্ট অগ্রগতি হয়েছে।
তথাপি সার্বিকভাবে দেখতে গেলে এখনও গরিব পরিবারের সংখ্যাও নেহাত কম নেই।
এই পরিবর্তনের সূত্র ধরে এখানকার নারীদেরও
যথেষ্ট পরিবর্তন ঘটেছে। পূর্ববঙ্গের ভাষা-সংষ্কৃতির অনেকটাই ভুলে গিয়ে এখানকার
ভাষা-সংস্কৃতির সঙ্গে মিলিয়ে একটা নতুন ভাষা-সংস্কৃতিতে অভ্যস্থ হয়ে অনেক নারী
লেখাপড়া শিখে সরকারি চাকরি করছে। বেশিরভাগ মেয়েরাই স্কুলশিক্ষিকা হয়েছে। সরকারি
অফিসের কর্মী, হাসপাতালের সেবিকা, ব্যাঙ্ককর্মী,
কলেজের শিক্ষিকা ইত্যাদি ছাড়াও একটু
কম লেখাপড়া জানা মেয়েরা অঙ্গনওয়াড়ি কিংবা আশাকর্মী হিসাবে নিয়োজিত হয়েছে। কেউ কেউ
সরকারি আধিকারিক হিসাবেও কর্মরত আছে। অবশ্য এইসব চাকরিবাকরি ও শিক্ষিত হবার
ব্যপারটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যেসব পরিবার আগে থেকেই শিক্ষার প্রতি সচেতন এবং
যত্নবান ছিল সেইসব পরিবারের মেয়েদের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। তপশিলি জাতির মেয়েদের চাকরি
পাওয়ার পেছনে অবশ্য সরকারি চাকরিতে সংরক্ষণ থাকাটাই একটি বড়ো সুযোগ হিসাবে কাজ
করেছে। উল্লেখ্য যে, এখানকার পুনর্বাসনপ্রাপ্ত বাঙালিদের সিংহভাগই
তপশিলি জাতির। পুরুষদের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি নারীরাও এখানকার কৃষ্টি-কালচারের সঙ্গে
সম্পূর্ণভাবে মিশে গিয়েছে। সংখ্যায় নগণ্য হলেও কিছু মেয়েরা বৈবাহিক সূত্রে যেমন
অবাঙালি বা আদিবাসীদের ঘরে গিয়েছে, তেমনি আদিবাসী মেয়েরাও
বাঙালিদের ঘরে এসেছে। অবশ্যই এসমস্ত প্রেমঘটিত কারণে সম্ভব হয়েছে।
ব্যবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রেও অনেক নারী সফলতার
সঙ্গে অংশগ্রহণ করছে। ছোটোখাটো চায়ের দোকান থেকে শুরু করে শাকসবজির দোকান, মুদিখানা,
মনোহারী দোকান, সেলাইয়ের কাজ, দরজির কাজ,
ছোটোখাটো হোটেল ইত্যাদিও পরিচালনা করছে নারীরা। এছাড়া অনেক জায়গায় বিউটি
পার্লারও চালু হয়েছে, যার সবটাই নারীদের দখলে।
তবে ইদানিং সারা দেশেই যেমন চাকরির বাজারে
মন্দা চলছে, তেমনি এখানেও একই অবস্থা চলছে। অনেক মেয়েরাও
এখন লেখাপড়া শিখে ছেলেদের মতো বেকার হয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে। অনেক শিক্ষিতা মেয়ে
গ্রাম্য চাষি পরিবারের বউ হয়ে গৃহস্থালী কাজকর্মে সংসারধর্ম পালন করছে। তবে আগের
মতো এখন আর মেয়েদের ধানঝাড়া, সেদ্ধশুকনো করে চাল
বানানোর পাট নেই। ঢেঁকির প্রচলন কবেই উঠে গেছে। এখন মেশিনে ধান মাড়াই-ঝাড়াই হয় এবং
সব ধান স্থানীয় চালকলের মালিকরা গ্রাম থেকেই কিনে নিয়ে যায়। গ্রামের পরিবারগুলির
প্রায় সকলেই বাজার থেকে প্যাকেটবন্দি চাল কিনে খেতে অভ্যস্থ হয়েছে। এখন বিনোদনের
যুগে এখানকার নারীরাও অনেকে ঘরে বসে কাজকর্মের মাঝেও টিভি দেখে সময় কাটাচ্ছে।
মোবাইলের ব্যবহারও সাধারণ নারীদের মধ্যে ব্যাপকভাবে প্রচলন হয়েছে।
চাকরি বা ব্যবসা করা শিক্ষিত পরিবারগুলি এখন আর
গ্রামে বাস করে না। তারা গ্রাম ছেড়ে প্রায় সবাই শহরে এসে বাড়ি করেছে। যারা বাড়ি
করতে পারেনি, তারা ভাড়াবাড়িতে থাকছে। এর একমাত্র কারণ শহরের
আশেপাশেই তৈরি হয়েছে অনেক ইংলিশ মিডিয়াম প্রাইভেট স্কুল। প্রাইভেট কলেজও তৈরি
হয়েছে। তার মধ্যে আছে কারিগরি কলেজও। তারা তাদের ছেলেমেয়েদের সেখানেই টাকাপয়সা খরচ
করে পড়াচ্ছে। সেখানে আছে প্রাইভেট টিউশনের ব্যবস্থা। ছেলেমেয়েরা যাতে আরো
উন্নতভাবে গড়ে উঠতে পারে সব বাবা-মায়েরই সেই প্রচেষ্টা। সেইসঙ্গে আছে শহরে বাস করার
অন্যান্য সুযোগসুবিধা। আর একটি ব্যাপার হচ্ছে- যেসব মেয়েরা চাকরি করছে, স্বভাবতই তাদের
বিয়ে হচ্ছে আরও একটু বেশি মাইনের চাকরি করা ছেলের সঙ্গে। সেসব দম্পতিরা সবাই শহুরে
বাসিন্দা হয়েছে জমি কিনে নিজস্ব বাড়ি বানিয়ে। সেসব মেয়েদের পোস্টিং পঞ্চাশ
কিলোমিটার দূরে হলেও তারা মোটর বাইক-স্কুটার চালিয়ে শহর থেকে যাওয়া-আসা করে ডিউটি
করছে অনায়াসেই। যোগাযোগ ব্যবস্থাও অনেক উন্নত; রাস্তাঘাট সব
গ্রামে যাবার জন্যই এখন পাকা। এ বিষয়ে এলাকার যথেষ্ট উন্নতিই হয়েছে বলতে হবে। আর
একটি কথা এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, একাকী মেয়েরা স্কুটার চালিয়ে
দশ-বিশ কিলোমিটার পথ সন্ধ্যার পরেও নির্ভয়ে চলাচল করতে পারছে। তবে এতকিছু হলেও
এখানকার নারীরা যে সম্পূর্ণ স্বাধীন হয়েছে, তা কিন্তু নয়।
এখনও তারা যতই শিক্ষিত হোক বা চাকরি করে আয় করে সংসারের সুরাহা করুক না কেন,
অধিকাংশ নারীরাই সেই আগের মতোই পুরুষনির্ভর বা বলা ভালো পুরুষতান্ত্রিক সমাজের
আদর্শ বজায় রেখেই চলছে।
সারা দেশের মতোই এখানকার গ্রামের স্কুলগুলির
অবস্থাও বিশেষ ভালো নয়। স্কুলগুলির ভালো বিল্ডিং থাকলেও লেখাপড়ার হাল খারাপই বলতে
হয়। পাশফেল ব্যবস্থা উঠে যাওয়ার ফলে পড়াশুনা হচ্ছে নামকা ওয়াস্তে। উপরন্তু মিড-ডে-মিল
খাওয়ানোর তদারকিতে শিক্ষকদের পাঠদানেও যথেষ্ট বিঘ্ন ঘটছে। গ্রামের অপেক্ষাকৃত গরিব,
যাদের শহরে রেখে পড়ানোর মতো অবস্থা নেই সেইসব পরিবারের ছেলেমেয়েরা বাধ্য হয়েই
গ্রামের স্কুলে পড়াশুনো করছে। সেইসব পরিবারের ছেলেদের মধ্যে কারো কারো পরে
হাইস্কুল ও কলেজে পড়ার সুযোগ হলেও মেয়েদের পক্ষে তা একদমই সম্ভব হয় না।
আগের মতো মেয়েদের এখন আর চাষের জমিতে কিংবা
অন্যত্র মজদুরের কাজে যেতে হয় না। আর্থিক অবস্থা যেমন অনেকটা ফিরেছে, তেমনি
রাজ্যসরকারগুলির নামমাত্র মূল্যে চাউল সরবরাহ, বিধবাভাতা,
বয়স্কভাতা ইত্যাদির কারণে একেবারে চরম দুরবস্থায় নেই কোনো পরিবারই। তবু তারই
মধ্যে খুব অল্পসংখ্যক হলেও দু-একজন বাঙালি নারীকে এখনও মজদুরের কাজ- বিশেষ করে
রাজমিস্ত্রির যোগানদার হিসেবে কাজ করতে দেখা যায় না এমন নয়।
গোরু-ছাগল চরানোর কাজেও এখন আর মেয়েদের যেতে হয়
না বললেই চলে। এর প্রধান কারণ, চাষের কাজে গোরুর ব্যবহার
অত্যন্ত কমে যাওয়া। গোরুর বদলে তার জায়গায় এসেছে ট্রাক্টর দিয়ে চাষ। গ্রামের অনেক
লোকই এখন ট্রাক্টরের মালিক। অন্য সবাই ভাড়া করে এনে প্রয়োজন মতো জমি চাষ করিয়ে
নেয়। ফসল কাটা ও মাড়াই করাও এখন অনেক জায়গায় যন্ত্রের সাহায্যে হচ্ছে। তাই অযথা
গোরু পোষার ঝামেলা রাখতে চায় না কেউ। শুধু দুধের জন্য গাই পোষাও বাদ দিয়েছে অনেকে।
এজন্য প্রায় গ্রামেই এখন দুধের অভাব। দুধের জন্য প্যাকেট দুধ বা আমূলই ভরসা।
সুতরাং এইসব কাজের সহায়তাকারী নারীদের কাজও ফুরিয়েছে। সে সময়টা তারা বিনোদনের কাজে
ব্যয় করতে পারে। অনাথ কিংবা খুব গরিব পরিবার হলে- তারা ছাগল পোষে, সেইসব পরিবারের
ছেলেদের সঙ্গে কোনো কোনো মেয়েরা এখনও ছাগল চরায়।
সার্বিকভাবে দেখতে গেলে সর্বভারতীয় নারীদের
অবস্থানের সঙ্গে দণ্ডকারণ্যের বাসিন্দা বাঙালি নারীদের বিশেষ কোনো পার্থক্য এখন আর
চোখে পড়ে না। যেটুকু পার্থক্য লক্ষ করা যায়, তা শুধু বিশাল
ভারতের আঞ্চলিক বিভিন্নতা জনিত ও সামান্য কিছুটা পূর্ববঙ্গীয় ভাষা-সংস্কৃতির
কারণেই রয়ে গেছে।
0 comments:
Post a Comment